শুঁটকি পল্লিতে বেতন বৈষম্যের শিকার হাজারো নারী
৮ মার্চ ২০২২ ০৯:৪৪
কক্সবাজার: কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লির সোলাইমানের মাছ খোলায় কাজ করছিলেন রাবেয়া খাতুন (৩৮)। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ তার স্বামী লিয়াকত মিয়া সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। সেই থেকে ৩ মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। পরিবারের খরচ যোগাতে বাধ্য হয়েই শুঁটকি মহালে দিনমজুরের কাজ করেন। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় কাজে আসেন, ফেরেন সন্ধ্যা সাতটায়। দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই টাকায় তার সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে মোহাম্মদ রমজান আলী (৪০) মজুরি পান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
এমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় পার্শ্ববর্তী ফরিদুল ইসলামের মাছ খোলায়ও। সেখানে কাজ করে ১৬ বছর বয়সী সাইমা। সে জানায়, তার বাবা শামসুল আলম দুই বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। অসুস্থ মা ও দুই ভাইবোনের সংসারের খরচ যোগাতে সে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। পায় মাত্র ৩০০ টাকা। ওখানেও পুরুষদের বেতন বরাবরই ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
বেতনে এমন বৈষম্য কেন? এমন প্রশ্নে তেমন কেউই কথা বলতে না চাইলেও ফরিদা ইয়াছমিন নামে এক নারী জানান, এই বৈষম্য নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের শুরু থেকে। এইটাই এখানকার নিয়ম। এর বাইরে কেউ কথা বললে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে। নির্বাচন করবে। সুতরাং কিছু করার নেই। পেট চালানোর জন্য এই অন্যায় মেনে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, শুধু সোলাইমান আর ফরিদুল ইসলামের মাছ খোলা নয়। নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের ৪৩৫টি মাছ খোলার প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার নারী-পুরুষের শ্রমের মজুরি হিসেবে এই রেইট নির্ধারণ করা হয়েছে। যে শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৬০ ভাগ।
বেতন বৈষম্যের ব্যাপারে জানতে মাছ খোলার মালিক জাফর আলমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সব জায়গাতে একই রেইট। এছাড়া নাজিরারটেকে নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায় ঠিক সেভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুষদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি বেতন দেওয়া হয়। একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন মাছ খোলার মালিক।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ জানান, নারীরা মাছ বাছাই, মাছ কাটা ও শুকানোর মতো হালকা কাজ করে। তাই তাদের বেতন কম। অপরদিকে পুরুষেরা মাছ বহন করা, ট্রাকে তোলা সহ বিভিন্ন ভারী কাজ করে। তাই তাদের বেতন বেশি।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় (১ নাম্বার ওয়ার্ড) কাউন্সিলর আক্তার কামাল জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে দিনমজুর হিসেবে যেসব নারী কাজ করে তাদের বেতন খুবই কম। সারাদিন পরিশ্রম করে তারা কাজের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার জায়গা থেকে অনুরোধ করব, নারী শ্রমিকদের বেতন যেন বাড়ানো হয়। তাদের মজুরি যেন পুরুষদের কাছাকাছি করা হয়।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অ্যাভোকেট সাকী-এ-কাউছার জানান, আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সবার সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যার বড় উদাহরণ নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লির শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের মজুরিতে বৈষম্য। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ এর দুই অনুচ্ছেদে নারীদের সমান অধিকার ভোগ করবে সেটা বলা আছে। কিন্তু এটা আসলে কেউ মানছে না।
মজুরির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যিনি মালিক তাকে নারীর অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। এইটা অবজ্ঞা করলে তাকে আইনের আওতায় আসবে হবে। সুতরাং একজন পুরুষ যতক্ষণ কাজ করে ঠিক ততক্ষণ একজন নারী কাজ করলে তাকে সমান মজুরিই দিতে হবে। তখনই নারীর অধিকার বাস্তবায়িত হবে।
সারাবাংলা/এএম