প্রবাসী আয়ে নারীর অবদান বাড়ছে
৮ মার্চ ২০২২ ১১:৫৯
ঢাকা: একটা সময় ছিল যখন এই অঞ্চলের নারীদের বাড়ির বাইরে যাওয়ায় ছিল প্রায় কল্পনাতীত, সেখানে সেই নারীই এখন দেশের বাইরে যাচ্ছেন। অবদান রাখছেন জাতীয় অর্থনীতিতে। গত ৩০ বছরে ১ লাখ ৪৫৬ জন নারী কাজ নিয়ে গেছেন পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
শুরুর গল্পটা দশক তিনেক আগের। ১৯৯১ সালে মাত্র ২ হাজার ১৮৯ জন নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে দেশের অর্থনীতিতে নিজের অবদান পোক্ত করেছিলেন। সেই যে শুরু, এরপর থেকে বিদেশে নারীদের যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছেই। তবে এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। কম যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের শ্রমবাজারে টিকে থাকতে গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসার সংখ্যাও কম নয়।
এখন পেছনের সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নারীদের যোগ্য করেই বিদেশে পাঠাতে চায় সরকার। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে কর্মক্ষেত্রে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে জনশক্তি রফতানিতে নারী কর্মী যুক্ত করা হয়। ওই বছর মোট ১২টি দেশে ২ হাজার ১৮৯ জন কর্মী পাঠানো হয়। এরমধ্যে সৌদি আরবে ২৯ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪১৭ জন, কুয়েতে ৪১৬ জন, ওমানে ৩৭ জন, বাহারাইনে ১৪৩ জন, লেবাননে ২৫ জন, মালয়েশিয়া ৯২৬ জন, সিঙ্গাপুরে ১ জন, লন্ডনে ২ জন, পাকিস্তানে ৩ জন, ব্রুনাইয়ে ৮ জন, মরিশাসে ১৭৮ জন আর অন্যান্য দেশে কাজ নিয়ে গেছেন আরো ৪ জন। সব মিলিয়ে ২১৮৯ জন।
তথ্য অনুযায়ী, পরের বছর ১৯৯২ সালে নারী জনশক্তি রফতানি হয় ১ হাজার ৯০৭ জন, ১৯৯৩ সালে ১ হাজার ৭৯৩ জন, ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৯৯৫ জন, ১৯৯৫ সালে ১ হাজার ৬১২ জন, ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ৯৯৪ জন, ১৯৯৭ সালে ১ হাজার ৭৬২ জন, ১৯৯৮ সালে ৯৩৯ জন, ১৯৯৯ সালে ৩৬৬ জন, ২০০০ সালে ৪৫৪ জন, ২০০১ সালে ৬৫৯ জন, ২০০২ সালে ১ হাজার ২১৬ জন, ২০০৩ সালে ২ হাজার ৩৫৩ জন, ২০০৪ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন, ২০০৫ সালে ১৩ হাজার ৫৭০ জন, ২০০৬ সালে ১৮ হাজার ৪৫ জন, ২০০৭ সালে ১৯ হাজার ৯৪ জন, ২০০৮ সালে ২০ হাজার ৮৪২ জন, ২০০৯ সালে ২২ হাজার ২২৪ জন, ২০১০ সালে ২৭ হাজার ৭০৬ জন, ২০১১ সালে ৩০ হাজার ৫৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩৩ হাজার ২০২ জন, ২০১৩ সালে ৫৬ হাজার ৪০০ জন, ২০১৪ সালে ৭৬ হাজার ৭ জন, ২০১৫ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন, ২০১৬ সালে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন, ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন, ২০১৮ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ জন। ২০২০ সালে মহামারি করোনার মধ্যেও ২১ হাজার ৯৩৪ জন নারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। যেখানে পুরুষকর্মী এর অর্ধেকও যেতে পারেননি।
২০২১ সালে কাজ নিয়ে বিদেশ গেছেন ৮০ হাজার ১৪৩ জন নারী। আর গত দুই মাসে গিয়েছেন ১০ হাজার ২৯০ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নারী কর্মী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, লেবানন, জর্ডান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন এবং মরিশাস দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি যান। বেশিরভাগ নারী গৃহকর্মী ও তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করে থাকেন। সৌদি আরবে বর্তমানে গৃহকর্মী নারীদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে। যেহেতু কম যোগ্যতায় বেশি সংখ্যক নারী পাঠানোর সুযোগ রয়েছে, সেহেতু সেখানে প্রতারণার ঘটনাও বেশি ঘটতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, নারীদের বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ার কারণে কাজের নিরাপত্তা ও বেতন বৈষম্য যাতে না থাকে সেজন্য সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও রয়েছে সরকারের। যদিও এই চুক্তির শর্ত মানে না কেউই!
অভিবাসী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক বছরে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে, তেমনই ফিরে আসার সংখ্যাও দেখেছি অনেক। আমরা কোনো নারীর ফিরে আসা দেখতে চাই না। সৌদি আরবের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করা হলে নারীদের প্রতারণার ঘটনা অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি এমন চুক্তি অন্য দেশগুলোর সঙ্গে করা যায় কীনা তা সরকারকে দেখতে হবে।’
অভিবাসন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে নারী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হারও। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্যমতে, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড প্রায় চার হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছিলো।
সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে নারী শ্রমিকরা বেশি হারে টাকা পাঠিয়েছেন। তারা পাঠিয়েছেন ৬৯ শতাংশ, সেখানে পুরুষ কর্মীরা পাঠিয়েছেন মাত্র ৩০ শতাংশ। বিদেশ যেতে যে পরিমান টাকা একজন নারীর খরচ হয়, তা গড়ে ছয় মাসের মধ্যেই তুলে আনতে পারেন নারীরা।
রামরু’র চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘অভিবাসন খরচের অনুপাতে নারী কর্মী পাঠানোর খরচ কম। ফলে কম সময়ে অভিবাসন ব্যয় তুলে আনা সম্ভব। অন্যদিকে নারীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হারও বেশি।’ সেদিক বিবেচনা করে নারীদের যোগ্য করে শ্রমবাজারে পাঠানোর ওপরে জোর দেন তিনি।
যেহেতু কম খরচে নারীদের শ্রমবাজারে পাঠানো যাচ্ছে, সেহেতু প্রবাসে নারীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও টেকসই করার দাবী দীর্ঘদিনের। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে দূতাবাসগুলোতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়াতে হবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘সরকার নারী কর্মীদের প্রতি জোর দিচ্ছে। বিএমইটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা চাই একজন নারীও যাতে প্রতারণার শিকার না হোন, তারা বৈধ উপায়ে যাবেন। তাদের কাজের নিরাপত্তা, সঠিক পারিশ্রমিক যাতে নারীরা পান, সে জন্য সরকারের উদ্যোগ রয়েছে।’
সারাবাংলা/জেআর/এএম/এমও