করোনা সংক্রমণের ২ বছর: এখনো প্রধান চ্যালেঞ্জ নমুনা পরীক্ষা
৮ মার্চ ২০২২ ২৩:০০
ঢাকা: ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে আতঙ্ক ছড়ায় রহস্যময় এক ভাইরাস। ২০২০ সালের শুরু থেকেই সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন দেশে। 2019-nCoV বা সার্স-কভ-২ নামের ভাইরাসটি শেষ পর্যন্ত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহামারি আকারেই গোটা বিশ্বকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে যাচ্ছে এখনো। তার ঢেউ থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। চীনে ২০১৯ সালের শেষে এই ভাইরাসের দেখা মিললেও বাংলাদেশে প্রথম এই ভাইরাসের উপস্থিতির তথ্য জানা যায় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সে হিসাবে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের দুই বছর পেরিয়ে শুরু হলো তৃতীয় বছর।
এরই মধ্যে গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের তিনটি ঢেউ দেখেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম দুই বারই হাসপাতালগুলোকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে রোগীদের জায়গা দিতে। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় টানা ১৯ দিন ধরে একেকদিন মারা গেছেন দুই শতাধিক মানুষ। সবশেষ এ বছরের শুরুতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে মৃত্যু ডেল্টা ঢেউয়ের রেকর্ড না ভাঙলেও প্রতিদিন কয়েক হাজার নতুন সংক্রমণ নতুন করে ভাবিয়েছে এই মহামারি নিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের প্রথম বছরে দেশে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হলেও মানুষের মাঝে আস্থা গড়ে তুলতে না পারায় বাড়তে থাকে ভীতি। এর সঙ্গে নানা রকমের সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি প্রকাশ্য হয়ে পড়ায় সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। প্রথম বছরের শেষ ভাগে এসে অবশ্য করোনার ভ্যাকসিন আশার আলো হয়ে দাঁড়ালেও সেখানেও ছিল নানা রকমের সমন্বয়হীনতা। এরপরও দেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রমে গতি আসায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ও মৃত্যুসংখ্যা কমে আসে।
করোনা সংক্রমণের এই দুই বছর পেরিয়ে এসেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা সবাই বলছেন, দুই বছরেও একটি চ্যালেঞ্জ এখনো বাংলাদেশ সফলভাবে অতিক্রম করতে পারেনি। সেটি হলো নমুনা পরীক্ষা। সাধারণ মানুষরা বলছেন, এখন পর্যন্ত চাইলেই সহজে নমুনা পরীক্ষা করার সুযোগ সরকার করে দিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, করোনার তৃতীয় বছরে এসে পরিসর বাড়িয়ে খুব সহজে মানুষের জন্য নমুনা পরীক্ষার সুযোগটাই হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল চ্যালেঞ্জ। কেননা চাইলেই নমুনা পরীক্ষার সুযোগই কেবল করোনায় আক্রান্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসার আওতায় আনার সুযোগ দিতে পারে। সরকারিভাবেই কেবল নয়, বিশেষজ্ঞরা বেসরকারি পর্যায়েও নমুনা পরীক্ষার খরচ কমিয়ে একে সহজলভ্য করার দাবি জানিয়েছেন। বলছেন, এর মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের গতিবিধি যথার্থভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
কোভিড–১৯ সংক্রমণ শনাক্তে প্রথম নমুনা পরীক্ষা
দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত করতে প্রথম নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২১ জানুয়ারি। চীনের চীনের উহান থেকে আসা একই পরিবারের দুই সদস্য বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের একজনের শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট পাওয়া যায়। পরে প্যান-করোনা পদ্ধতিতে তাদের দু’জনের নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর)। সেটিই ছিল দেশে প্রথম করোনা পরীক্ষা। ২২ জানুয়ারি তাদের নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। প্যান-করোনা পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগে বলে পরে আর আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা শুরু হয় দেশে।
প্রথম কোভিড–১৯ সংক্রমণ শনাক্ত
২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি দেশে নমুনা পরীক্ষা শুরু হলেও প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে তিন জনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তিন জনের মধ্যে দু’জন ইতালি থেকে ফিরেছিলেন। তৃতীয় ব্যক্তিও তাদেরই পরিবারের একজন।
দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু
করোনা সংক্রমণ নিয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে সেদিন জানানো হয়, সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। শ্বাসকষ্ট (সিওপিডি) ছাড়াও হৃদরোগ ও কিডনিজনিত সমস্যা ছিল তার। তিনি স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঘোষণা
ওই বছরেরই ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতর ব্রিফিংয়ে জানায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে সীমিত আকারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে থাকতে পারে। পরে ১ এপ্রিল দেশে সামান্য মাত্রায় করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হশুরু হয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ভাইরোলজিস্ট খন্দকার মাহবুবা জামিল। আর ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে করোনাভাইরাসের ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণা
২৩ মার্চ সচিবালয়ে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ওই সময় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সাধারণ ছুটির আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস বন্ধ থাকলেও কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান, হাসপাতাল এবং জরুরি সেবা এর আওতার বাইরে ছিল। পরে এই সাধারণ ছুটি ধাপে ধাপে বাড়ানো হয় জুন পর্যন্ত।
প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু
দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ৫ এপ্রিল সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মঈন উদ্দিনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ৭ এপ্রিল তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে তাকে সিলেটে শহিদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ এপ্রিল সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ এপ্রিল সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
প্রথম ২ বছরের সংক্রমণ শনাক্তের তুলনামূলক চিত্র
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর ২০২১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রথম এক বছরে দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৫টি। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩৩ নমুনায়। এই বছরে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয় আট হাজার ৪৬২ জনের।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৯৪ লাখ ৭৪৫টি। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭২টি নমুনায় করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয় ২০ হাজার ৬২৭ জনের।
এই হিসাব বলছে, প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে সোয়া দুই গুণেরও বেশি। তবে এই সময়ে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে প্রথম বছরের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি। দ্বিতীয় বছরে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুও হয়েছে প্রথম বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৪৩ গুণ।
ব্যবধান গড়েছে ভ্যাকসিন
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের প্রথম বছরে নানা ভ্যারিয়েন্টের মাঝে প্রাধান্য দেখা যায় বাংলাদেশ লিনিয়েজের। এই সময়ে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হলেও মৃত্যুতে তার প্রভাব সংখ্যাগত পরিসংখ্যানে দেখা যায়নি। তবে দ্বিতীয় বছরে ডেল্টা, আলফা, বেটা, গামাসহ বছরের শেষ ভাগে ওমিক্রনের প্রভাব দেখা যায় সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য। আর তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম বছরের তুলনায় দেশে নানারকম ভ্যারিয়েন্টের কারণেও সংক্রমণে প্রভাব পড়েছে। তবে এই প্রভাবগুলো কাটিয়ে উঠে মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করেছে ভ্যাকসিন প্রয়োগ।
দেশে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ে। এরপরে ধাপে ধাপে নানা বয়সসীমায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সরকার।
করোনা সংক্রমণের দুই বছর তথা ২০২২ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত হিসাব বলছে, দেশে ১২ কোটি ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার ৭২১ জনকে অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন আট কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪৬ জন। আর ৪৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৩৩ জন পেয়েছেন ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাঠগড়ায় নমুনা পরীক্ষা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। দুই বছরের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে সারাবাংলা কথা বলেছে তার সঙ্গে।
অধ্যাপক ডা. নজরুল সারাবাংলাকে বলেন, দেশে প্রথম বছরের তুলনায় বেড়েছে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা। আর তাই বেড়েছে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যাও। অর্থাৎ এটা প্রমাণিত যে নমুনা পরীক্ষা বাড়ালে সংক্রমণ শনাক্তের একটি চিত্র আমাদের সামনে আসে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত দেশের সবখানে সহজে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি। দেখা যায়, দেশে সংক্রমণ বাড়লে তার চাপ পড়ে ল্যাবগুলোতেও। সেখানে কাজ করা টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে অন্যরাও যখন সংক্রমিত হন, তার প্রভাব পড়ে। মাসখানেক আগেও যখন সংক্রমণ বাড়ল, তখন কিন্তু নমুনা দিয়েও দিনের পর দিন ফল না পাওয়ার খবর আমরা দেখেছি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা নেই। সংক্রমণ কমে এলেও এখনো অনেকে সঠিক সময়ে নমুনা পরীক্ষার ফল না পাওয়ার অভিযোগ করছেন।
তিনি বলেন, এ তো গেল নমুনা পরীক্ষার ফলের কতা। নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও কিন্তু সহজ নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য নমুনা পরীক্ষার সহজ সুযোগ বাড়াতে হবে, যেন তারা খুব কাছেই কোথাও নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পান। এই জায়গাটিতে আমরা গত দুই বছরেও ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার খরচও কমানো গেলে সাধারণ মানুষের সুবিধা হবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ডা. নজরুল বলেন, করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বকেই ভুগিয়েছে। আমাদের এখানেও আমরা শুরুতে করোনা সংক্রমিতদের চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা করতে পারিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তারপরও এখনো সংক্রমণ বেড়ে গেলেই হাসপাতালগুলোকে চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যথাযথ পরিকল্পনা জরুরি। সংক্রমণের হার কম থাকুক বা বেশি থাকুক, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত রাখতে আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ এবং সচেতনতাকে এখনো গুরুত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক ডা. নজরুল। বলছেন, দুই বছরে জনগণের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা কিছুটা তৈরি হয়েছে। তবে তা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। অসুস্থবোধ করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাও জরুরি, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথভাবে মানুষকে সচেতন করে তোলা গেলে আশা করা যায় তৃতীয় বছরে বাংলাদেশ কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকবে। পাশাপাশি ভ্যাকসিন প্রয়োগের যে ধারাবাহিকতা, এটি অব্যাহত রেখে শতভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। তাতে মহামারি নির্মূল হয়ে না গেলেও এর ভয়াবহতা কমে আসবে।
করোনার নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মুশতাকও।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হলো— আমাদের দেশের একটি বিশাল অংশ কিন্তু সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে এখনো। দেখা গেল নমুনা পরীক্ষা করাতে তাদের একটু বেশি পথই পাড়ি দিতে হচ্ছে বা নানারকম সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। তাই তাদের পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে উৎসাহী করতে হবে। পাশাপাশি তারা যেন সহজে ও নির্বিঘ্নে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেন, সেই ব্যব্স্থাও করতে হবে। কেননা, পর্যাপ্ত পরিমাণে নমুনা পরীক্ষাই কেবল মহামারির প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরতে পারে।
ডা. মুশতাক আরও বলেন, যেকোনো ভাইরাস নিয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। বারবার ধরন পরিবর্তন করে করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট সব দেশকেই ভুগিয়েছে। তারপরও যদি সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে মহামারির ভয়াবহতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় তুলে ধরে ডা. মুশতাক বলেন, প্রথমত চিকিৎসাসেবা বাড়াতে হবে। এছাড়া সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ও কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারিভাবে আমাদের এখানে যে নমুনা পরীক্ষার খরচ, সেটি কমানো গেলে মানুষের জন্য অনেক সুবিধা হবে। ভ্যাকসিনের কারণে আমাদের মৃত্যুহার কমেছে। তৃতীয় বছরে তাই সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ থাকবে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো।
জানতে চাইলে দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, বিগত এক বছরে আমরা যেভাবে ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে চলমান রেখেছি, তা প্রশংসার দাবি রাখে। এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। একইসঙ্গে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাতেও সক্ষমতা বেড়েছে। সচেতনতার পর্যায়েও অনেকটা উন্নতি হয়েছে বর্তমানে। এই অর্জনগুলোকে ধরে রেখে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে হবে। এমন প্রস্তুতি রাখতে হবে, যেন যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দেখা দিলেও মানুষকে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে না হয়।
ডা. সহিদুল্লাহ আরও বলেন, তৃতীয় বছরে মূল চ্যালেঞ্জ হবে সফলতাগুলোকে ধরে রেখে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো। এরই মধ্যেই আমাদের এখানে অনেক ল্যাব হয়েছে। পরীক্ষার ধরনও বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। শহরেও নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এগুলোকে সহজ করতে হবে। সময় ও নমুনা সংগ্রহের স্থান বাড়াতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে আমরা একটি ভালো অবস্থানে থাকব বলে আশা করছি।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
করোনা ভ্যাকসিন করোনা সংক্রমণ করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়