Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেগা প্রকল্পে সমন্বয়হীনতা, থেমে আছে রেলের গুরুত্বপূর্ণ কাজ

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ মার্চ ২০২২ ১১:০৭

ঢাকা: গ্যাস সংযোগের কাজ শেষ না হওয়ায় পদ্মাসেতুতে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে পারছে না রেলপথ মন্ত্রণালয়। সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মাসেতুতে সড়কের পাশাপাশি অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করার পরেই লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে পারবে রেলওয়ে। আর পদ্মাসেতু রেল লিংক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রেললাইন স্থাপনের সব প্রস্তুতি শেষ করে বসে রয়েছেন তারা।

এদিকে, রাজধানীর শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন উড়াল সড়কের কারণে থেমে রয়েছে রেলওয়ের আরেক প্রকল্প ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উড়াল সড়কের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্পও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও জানিয়েছেন, এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই রেলকে এগিয়ে যেতে হবে।

রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। ঢাকার যানজট অর্ধেক কমিয়ে আনার পাশাপাশি রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ অংশের সংযোগ ও ট্রাফিক ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালে সরকার হাতে নেয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। হযরত শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজাগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কুতুবখালী (ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক) পর্যন্ত প্রায় ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় চার বছর। সে লক্ষ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামে প্রকল্পটি ওই বছরের ৩০ নভেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্পটি তিন ধাপে নির্মাণের কাজ শুরু করে সেতু বিভাগ। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ ও বিনিয়োগ জটিলতায় কাজে আসে ধীর গতি। জটিলতা দেখা দেয় অর্থায়ন ও নকশায়। যে কারণে চার বছর মেয়াদের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ করা যায়নি। জানা গেছে, এই প্রকল্পে গত ১০ বছরে চারবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে উড়ালসড়কের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

অন্যদিকে, বাকি অংশের কাজ ২০২৩ সালে শেষ করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যদিও প্রকল্প পরিচালক এম এস আকতার সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, যথা সময়েই নির্ধারিত অংশের কাজ শুরু করা যাবে। প্রকল্পটিতে যেসব সমস্যা ছিল তা এখন কেটে গেছে। প্রথম ধাপে চলতি বছরেই তেজগাঁও রেল স্টেশন পর্যন্ত মোট ১১কিলোমিটার চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

এদিকে, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন সম্প্রসারণের যে উদ্যোগ রেলপথ মন্ত্রণালয় নিয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে তা থেমে রয়েছে। প্রকল্পের নথি বলছে, এই রেললাইনের পথ ধরে এগোচ্ছে উড়াল সড়কের নির্মাণ কাজ। যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ ৩য় ও ৪র্থ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালের ১৩ নভেম্বর। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও নকশায় ভুল থাকার কারণে গত ১০ বছরে এ প্রকল্পে তেমন গতি আসেনি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের অন্য অংশের কাজ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে প্রকল্প এলাকার জমি এখনও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি। ফলে ওই ১০ কিলোমিটার অংশে কাজ শুরুই হয়নি। কবে নাগাদ কাজ শুরু করা যাবে এবং কবে শেষ হবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। উল্টো বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে প্রকল্পটির মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে তিনগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতায় সরকারের এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় এবং সময় নষ্টের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু একটা/দুইটা নয়, এমন অনেক প্রকল্প দেখেছি যেখানে সমন্বয়ের অভাব ছিল। পেশাদারিত্বের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ দীর্ঘসূত্রিতা হয়ে গেছে, তা ভবিষ্যতের কোনো প্রজেক্টের জন্যই সুখকর নয়। যে বিনিয়োগ করছে সে কিন্তু হতাশ। এসবের ফিডব্যাক অন্য দেশে চলে যায়। যা ভবিষ্যতে অর্থ সহায়তা পেতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল তথ্য চলে যায়।’

আরেক প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’। সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প এটি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যা এখন বাস্তব ও দৃশ্যমান। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রতীক্ষিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন স্থাপনের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগের পরিকল্পনা রয়েছে। এই রেলপথ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩ জেলায় প্রথম রেলসংযোগ স্থাপন করবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সঙ্গে ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ ও পদ্মাসেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ হবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি তিন ভাগে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলতি বছরের জুনের মধ্যে পদ্মাসেতুর সড়ক পথের সঙ্গে সঙ্গে রেলপথে মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২কিলোমিটার অংশ আগে চালু করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই পরিকল্পনা এখন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব না। কারণ পদ্মাসেতু রেল লিংক প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে রেললাইন স্থাপনে অন্তত ছয় মাস আগে থেকে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। যা সেতু বিভাগ অনুমতি দেয়নি।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মাসেতুর ওপর রেলপথ তৈরির নির্দিষ্ট অংশে এখন চলছে গ্যাস লাইন স্থাপনের কাজ। এসব কাজ শেষ করতে আরও দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। আর এই সময়ের মধ্যে রেললাইন স্থাপনের কাজ কোনোভাবে করা যাবে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও অনুমতি দেয়নি সেতু বিভাগ। ফলে এখানেও প্রস্তুতি নিয়ে সড়ক অংশের কাজ শেষ না হওয়ায় বসে থাকতে হচ্ছে রেলওয়েকে। এ কারণে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সবধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, তা আর হচ্ছে না। আসছে জুনে পদ্মাসেতু গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও রেললাইন স্থাপনে বিলম্ব হওয়ায় সেতু দিয়ে ট্রেন চলতে পারছে না বলে ধরেই নেওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আসলে পরিকল্পনা থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছি। সেজন্য পদ্মাসেতুর সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে রেল চলাচল উদ্বোধন করা সম্ভব হবে না। পরিকল্পনা ছিল, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত একই দিন রেলকে নিয়ে যাব। কিন্তু সেতু বিভাগ কয়েক মাসের আগে রেললাইন স্থাপনের জন্য অনুমতি দিতে পারবে না। সেহেতু আমরা রেলের কাজ শুরু করতে পারছি না। শুধু এটি নয়, অন্য প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’

সরকারের সব কাজই তো জনগণের জন্য; সেজন্য বাস্তবতা নিয়েই উন্নয়ন করতে হবে বলে জানান রেলমন্ত্রী।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প ট্রেন লাইন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ ৩য় ও ৪র্থ লাইন পদ্মাসেতু মেগা প্রকল্প রেলওয়ে


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভূতের গলির বাসায় মিলল বৃদ্ধের মরদেহ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:০০

সম্পর্কিত খবর