Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবিতার বইয়ে ‘সয়লাব’ অমর একুশে বইমেলা

আসাদ জামান
৯ মার্চ ২০২২ ০০:১৭

‘কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ।’ এই মায়ার জগতে বিরচণ করেনি— এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দায়। বাঙালি প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, প্রেমে ব্যর্থ হয়েও কবিতা লেখে। আনন্দ যাপনের জন্য কবিতা লেখে, বিরহ যাপনের জন্যও কবিতা লেখে। এ দেশের নদী-জল, ফুল-ফল, পাখ-পাখালি, মাঠ-চৈতালি, মানুষ-প্রকৃতি, সংগ্রাম-রাজনীতি— সবকিছুই কবিতার সার্থক উপকরণ।

সে কারণেই হয়তো কবিতা লেখা বাঙালির ‘সহজাত প্রবৃত্তি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌবনে কবিতা লেখেনি— এমন লোক খুব কমই আছে। তবে ‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে প্রথম প্রেমে পড়ার বেলায়, প্রকাশ ঘটে অমর একুশে বইমেলায়। এবারও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। কবিতার বইয়ে ‘সয়লাব’ হয়ে গেছে মেলা। মঙ্গলবার (৮ মার্চ) পর্যন্ত মেলায় আসা নতুন বইয়ের এক-তৃতীয়াংশই কাব্যগ্রন্থ।

বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্য বলছে, মেলার প্রথম ২২ দিনে মোট বই এসেছে ২ হাজার ৩৫৬টি। এর মধ্যে কবিতার বই ৭৪৫টি। একক বই হিসেবে এটিই সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বইয়ের তালিকায় রয়েছে উপন্যাস (৩৬৪), তৃতীয় সর্বোচ্চ বইয়ের তালিকায় রয়েছে গল্প গ্রন্থ (৩০৭)।

এছাড়া প্রবন্ধ গ্রন্থ এসেছে ১১৯টি, গবেষণা গ্রন্থ ৬০টি, ছড়ার বই ৪২টি, শিশুতোষ গ্রন্থ ৫৬টি, জীবনী গ্রন্থ ৬৮টি, রচনাবলি ৯টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ৭৬টি, নাটক ১৪টি, বিজ্ঞানের বই ৩৮টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৩৮টি, ইতিহাস বিষয়ক ৪৯টি, রাজনীতি বিষয়ক ১৩টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ১৩টি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৬৬টি, রম্য গ্রন্থ ১০টি, ধর্মীয় গ্রন্থ ২৭টি, অনুবাদ গ্রন্থ ১৯টি, অভিধান ছয়টি, সায়েন্স ফিকশন/গোয়েন্দা গল্প ৩৭টি এবং অন্যান্য গ্রন্থ ১৮০টি।

বিজ্ঞাপন

নিছক পরিসংখ্যান দিয়ে মেলার সংবাদ হতে পারে না— এমন বিশ্বাস থেকেই আগের দিন পাওয়া তথ্য মগজদাবা করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লাম। ফাল্গুনের ২৩তম দিনে এসে বসন্তের মিষ্টি রোদ তখন কিছুটা হলেও তেজ দেখাচ্ছে। সে কারণেই হয়তো বাংলা একাডেমির পুকুর পারের শিরিশ, দেবদারু, বহেড়া, হরিতকি, মেহেগুনী, আম, কাঠাল, অশোক, তেতুল, নীম, বাঁশ ও নারিকেল গাছের পাতার নিচে দোদুল্যমান ছায়ার দখল নিতে রীতিমতো ঝগড়া-বিবাদেরত কোকিল, দোয়েল, চড়ুই, কাক, ঘুঘু ও শালিকের ঝাঁক।

তাদের কুহু-কুহু, কিচির-মিচির, টু-টু, ফ্রিং-ফ্রিং, কা কা ডাক হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে জগতে আর দুঃখ-শাপ, ব্যথা-পরিতাপের চিহ্ন থাকে না। মুহূর্তের জগৎটাকে চিরকালের ডানায় বেঁধে পার্থিব বোধের সংকীর্ণতা থেকে অপার্থিব বোধে নিয়ে যাওয়া যায়।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের পশ্চিম দেয়াল ঘেষে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাচীর সংলগ্ন বুড়ো শিরিশ গাছটিতে এক জোড়া কোকিল কুহু কুহু ডাকছিল। আর আমি ‘জয় বাংলা’ গবেষণা ও প্রকাশনার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে জলকেলির শব্দ ভেসে এলো। চেয়ে দেখি একাডেমি প্রাঙ্গণের পুকুরের জলে পা ভিজিয়ে সিঁড়ির ওপর বসে জলকেলি করছে তিন ষোড়শী।

কৃত্রিম জলপ্রপাতের শব্দ আর ষোড়শী ত্রয়ের পদযুগলে জলের চুম্বন— সে এক দেখার মতো দৃশ্য, উপলব্ধি করার মতো ক্ষণ, হৃদয়ে ধারণ করার মতো মুহূর্ত। বস্তুতপক্ষে তপোবন সদৃশ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণজুড়ে এমন দৃশ্যের অভাব নেই। অভাব শুধু দেখার মতো চোখ, লেখার মতো হাতের। চোখ নেই বলে দেখতে পারি না, হাত নেই বলে লিখতে পারি না।

তবে কবিতা লেখার মতো লোকের অভাব যে নেই, সেটি নিচের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়। মেলা শুরুর পরদিনই তিনটি নতুন কবিতার বই এসেছে। তৃতীয় দিনে এসেছে ১৫টি, চতুর্থ দিনে ৬০টি, পঞ্চম দিনে ২৮টি, ষষ্ঠ দিনে ২৪টি, সপ্তম দিনে ৮১টি, অষ্টম দিনে ১৮টি, নবম দিনে ৩৩টি, দশম দিনে ২৭টি, একাদশ দিনে ৭০টি, দ্বাদশ দিনে ৩৫টি, ত্রয়োদশ দিনে ১৪টি, চতুর্দশ দিনে ৩৩টি, পঞ্চদশ দিনে ১৯টি, ষোড়শতম দিনে ৪৯টি, সপ্তদশ দিনে ৬০টি, অষ্টদশ দিনে ৮১টি, ঊনবিংশতম দিনে ৪২টি, বিংশতম দিনে ১৫টি, একবিংশতম দিনেও ১৫টি এবং দ্বাবিংশতম দিনে ২৩টি কাব্যগ্রন্থ। অর্থাৎ গত ২২ দিনে ৭৪৫ জন কবির নতুন বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। কবিদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

কবিতার বই তো এলো, বিক্রি হচ্ছে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচটি প্রকাশনীর স্টল ও প্যাভিলিয়নে কথা বলে যেটি জানা গেল, সেটি রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।

অপেক্ষাকৃত নতুন প্রকাশনী আলোকায়ন এবারের বই মেলায় নতুন বই এনেছে ১০টি। এর মধ্যে কবিতার বই তিনটি। অর্থাৎ নতুন বইয়ের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই কাব্যগ্রন্থ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— ফারুক হোসাইন নীলের ‘আমি প্রেমিক হবো’, ইয়াকুব আলী মিন্টুর ‘কষ্টের ডিঙি’ এবং মুরাদ হোসেনের ‘প্রেম দ্রোহ এবং প্রার্থিত সুন্দর’।

আলোকায়নের বিক্রয়কর্মী রবিউল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, এই তিনটি বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ‘প্রেম দ্রোহ এবং প্রার্থিত সুন্দর।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত কপি বিক্রি হয়েছে?’ উত্তরে জানালেন— ১০ কপি!

অপেক্ষাকৃত পুরনো এবং নামকরা প্রকশনী নালন্দা এবার নতুন বই এনেছে ৩০টির মতো। এগুলোর মধ্যে কবিতার বই রয়েছে ১০টি। জান্নাতুন নুর দিশার ‘শতাব্দীর কোলাহল’, মনদীপ ঘরাইয়ের ‘আমাকে বোঝেনি কেউ’, শহীদুল জাহীদের ‘যে সূর্য স্পর্শে ধরনি শীতল’, রাজীব হোসেনের ‘মেঘে মেঘে বেঁচে থাকো’, নাসরিন বেগমের ‘চেনা অচেনা কথা’, ‘বালিকার অভিনন্দন’ ও ‘পালকির বালিকা’ এর মধ্যে অন্যতম।

কবিতার বই বিক্রি কেমন?— জানতে চাইলে নালন্দার ম্যানেজার জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কবিতার বই কেউ কেনে না। তারপরও নবীন কবিদের উৎসাহ যোগানোর জন্য আমরা তাদের বই বের করি।’

কথা প্রকাশ থেকেও বেরিয়েছে দুইটি কবিতার বই। এর একটি নির্মলেন্দু গ‍ুণের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’, আরেকটি আহসান হাবিবের ‘হারিয়ে যাওয়ার পায়ের চিহ্ন’।

কথাপ্রকাশের ম্যানেজার জাফিরুল ইসলাম জানালেন, নতুন আসা দুইটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে নির্মলেন্দু গ‍ুণের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’ কিছু কপি বিক্রি হলেও আহসান হাবিবের ‘হারিয়ে যাওয়ার পায়ের চিহ্ন’ তেমন বিক্রি হচ্ছে না।

গ্রন্থ প্রকাশের বিক্রয়কর্মী মো. মামুন জানালেন, এবারের বইমেলায় তারা দুইটি নতুন বই এনেছেন। দুইটিই কাব্যগ্রন্থ। একটি সাগর কবিরের ‘হৃদয় বীণার সুর’, আরেকটি জামিনুর ইসলামের ‘জীবন্ত ঝলসে যাওয়া উদ্ভাস’। মামুনের দেওয়া তথ্যমতে, এ দুইটি কাব্যগ্রন্থের একটি কপিও বিক্রি হয়নি। এমনকি কবিরা নিজেও আসেননি স্টলে। নিজের ফেসবুকেও চালাননি বইয়ের প্রচারণা।

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

কবিতার বই টপ নিউজ বইমেলা বইমেলা ২০২২

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর