সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকারের মানে বঙ্গবন্ধুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা
৯ মার্চ ২০২২ ১৯:০০
ঢাকা: সিরাজুল আলম খানকে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের অন্যতম ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ ও ‘রূপকার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি বলেছেন, সিরাজুল আলম খান নিজেই ইতিহাস। তাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তাকে অস্বীকার করার অর্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা।
বুধবার (৯ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে রব এসব কথা বলেন। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ‘কল্পকাহিনী’ ও ‘বিষোদগারে’র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে রব নিজেও একজন অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎকালীন রব-ই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের অন্যতম ঘনিষ্ঠদেরও একজন তিনি।
আ স ম আবদুর রব বিবৃতিতে সিরাজুল আলম খানকে প্রসঙ্গে বলেন, বাঙালি জাতিরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠন, শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার পরিকল্পনা, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠন, বাংলাদেশের পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, জয় বাংলা স্লোগান নির্ধারণের মতো আন্দোলন-সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশলসহ বহু যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও ঐতিহাসিক ঘটনার নেপথ্য নায়ক সিরাজুল আলম খান। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম কারিগর তিনি। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ স্বাধীনতার পটভূমি তৈরির ইতিহাসে অন্যতম চরিত্র সিরাজুল আলম খান। তিনিই ছাত্র-যুব সমাজকে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত করেন এবং স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করেন।
আরও পড়ুন- ‘বাবা বললেন— লিডার লিডস দ্য ল্যাড, ল্যাড শুড নট লিড দ্য লিডার’
সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রণয়নে তিনি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ছিল তার একান্ত সম্পর্ক। স্বাধীনতার পরে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধের জের ধরে জাসদ গড়ে তোলেন সিরাজুল আলম খান।
আশির দশক থেকেই নিভৃতবাস বেছে নেন সিরাজুল আলম খান। কাউকে সাক্ষাৎ দেন না সচরাচর, তেমন একটা কথা বলেন না কারও সঙ্গে। তিনি নিজে লেখালেখিও করেন না। তবে তার সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখনের মাধ্যমে বের হয়েছে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। একান্ত ঘনিষ্ঠ দুয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন সিরাজুল আলম খান। এমন হাতেগোনা দুয়েকটি সাক্ষাৎকার এসেছে গণমাধ্যমে।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমালোচনা করেন সিরাজুল আলম খানের। বলেন, একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের আগের দিন সন্ধ্যাতেও সিরাজুল আলম খানসহ তার সহযোগীরা বঙ্গবন্ধুকে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন, ভাষণে যেন তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে অসন্তুষ্ট হন সিরাজুল আলম খানসহ অন্যরা। ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফিরলে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানান। তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, সাধারণ মানুষ এই ভাষণে হতাশ হয়েছে।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ওই সময় সিরাজুল আলম খানসহ তার সঙ্গীরা মিথ্যাচার করেছিলেন। কেননা ৭ মার্চের ভাষণের পর মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাদের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটিই যেন ভাষণে তারা খুঁজে পেয়েছিল।
শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে আ স ম আবদুর রব বলেন, একাত্তরের ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাৎক্ষণিক নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত। তখনকার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার বলয়, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সংগ্রামের সম্ভাব্য পথরেখা এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির পাশাপাশি যুগপৎ অসহযোগ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের ডাক এবং স্বাধীনতার আহ্বান— সবকিছুই ছিল পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ। এসব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ইতিহাস থেকে সিরাজুল আলম খানকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো অবকাশ নেই। তাৎক্ষণিকতা দিয়ে একটি পরাধীন জাতিকে রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের দিকে ধাবিত করা যায় না।
রব বলেন, ছাত্রলীগকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। নিউক্লিয়াস ও সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। সিরাজুল আলম খান সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার বেদিতে, ব্যক্তিগত কোনো প্রাপ্তি বা খ্যাতির জন্য নয়।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জেএসডি সভাপতি বলেন, বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনমনীয়, অতুলনীয়। সিরাজুল আলম খানকে ইতিহাসই ধারণ করবে। কেউ ইচ্ছা করলেই ইতিহাস থেকে তাকে ছেঁটে ফেলতে পারবে না। কারণ সিরাজুল আলম খান নিজেই ইতিহাসের বিষয়। ঐতিহাসিক ন্যায্যতার প্রয়োজনে সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একটি পরিবারে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চলছে অভিযোগ করে আ স ম আবদুর রব বিবৃতিতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে যার যা অবদান, সবকিছু মুছে ফেলে গোটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একটি পরিবারের কাছে বলি দেওয়া হচ্ছে। এটি ভয়ংকর অন্যায়। ইতিহাস থেকে মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানীসহ সেক্টর কমান্ডারদের অনন্যসাধারণ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
আ স ম আবদুর রক আ স ম আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সিরাজুল আলম খান