‘বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নারীর অবদান সর্বাধিক’
৯ মার্চ ২০২২ ২২:৫৯
ঢাকা: স্বাধীনতার ৫০ বছরে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ অগ্রগতিতে নারীর অবদান সর্বাধিক বলে মন্তব্য করেছেন উইমেন ফর উইমেনের সভাপতি ড. নিলুফার বানু। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির আয়োজনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। এ সময় কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম সেক্টরে নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য হলেও প্রত্যাশিত নারী-পুরুষ সমতায় পৌঁছাতে তাদের আরো অনেকদূর অগ্রসর হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বুধবার (৯ মার্চ) ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন উপলক্ষে ‘নারী- পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূলকথা’— প্রতিপাদ্যের আলোকে ‘নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করো, সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করো’- এই স্লোগান সামনে রেখে ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে উইমেন ফর উইমেনের সভাপতি ড. নিলুফার বানু ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম মডারেশন আয়োজিত ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য শিরিন আখতার ও সংসদ সদস্য শবনম জাহান। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন উইমেন ফর উইমেনের সভাপতি ড. নিলুফার বানু। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয়- বিষয়ে আলোচনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়- বিষয়ক আলোচনা করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী। বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনসমূহ ও করণীয় বিষয়ক আলোচনা করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক অ্যাড. নিনা গোস্বামী এবং নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ পরিবর্তনে করণীয় বিষয়ক আলোচনা করেন অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাননীয় সংসদ সদস্য শিরিন আখতার নারী-পুরুষ সমতাকে নিশ্চিত করে টেকসই সমাজ-গঠনের জন্য করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, `অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নতির সাথে সামাজিক অবকাঠামো উন্নতি না হওয়ায় প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিনিয়ত হলেও কাজীদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোরীদের সচেতন করতে কিশোরী ক্লাব গঠনের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে যা অব্যাহত রাখতে হবে। বহুবিবাহ এখনও নারীরা সহ্য করে যাচ্ছেন কিন্তু এখনো বিষয়টি তেমন সামনে আসছে না।’
তিনি বলেন, ‘নারীকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নে মনিটরিং এর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে, এ বিষয়ে নারীদের নিকট তথ্য প্রচারের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সমতা নিশ্চিতে সামগ্রিক সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের মধ্যে নিহিত সুনির্দিষ্ট বৈষম্যগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে আইন প্রণয়নের জন্য ৭১ নম্বর বিধি, ১৪৭ ধারার সাধারণ প্রস্তাবের আলোকে পয়েন্ট অব অর্ডারে ও কক্কাসের মাধ্যমে সংসদে দাবি উত্থাপন করতে হবে।’
পাশাপাশি স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্জিত নানা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নারীর উন্নয়নের পথে বাধাদানকারী শক্তি মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গী শক্তিকে মোকাবিলা করতে সকলকে দৃঢ় ও কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনাকালে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী বলেন, ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অবস্থার পরিবর্তনে বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করতে হবে, সরকারি সুবিধা গ্রহণে প্রদানকৃত শর্তগুলো নারীর জন্য সহজ করতে হবে এবং গণমাধ্যমে আরও বেশি করে তথ্য সম্প্রচার করতে হবে।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘পরিবার ও কর্মক্ষেত্রেসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রিভেনশন, প্রোটেকশন, প্রভিশন, পার্টিসিপেশন ও রিপোর্টিংয়ের আলোকে আলাদা আলাদা করণীয় ঠিক করতে হবে। সহিংসতা প্রতিরোধ করে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা নিয়মিত রিভিউ করা, সহজে জেন্ডার সংবেদনশীল ডাটা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, এর পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু কাজ হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পরবর্তী সুপারিশমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক অ্যাড. নিনা গোস্বামী বলেন, ‘৮০’র দশক থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংস্কার ও প্রণয়নে জোর দাবি উত্থাপন করলেও সরকারের তৎপরতা এখনো পর্যন্ত তেমন দেখা যায় না। এ ছাড়াও বাধা অতিক্রম করে নারীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনের সংস্কার করতে হবে।’
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, ‘সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি হওয়া বৈষম্যগমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে আমাদের সমতার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার দিকটি তুলে ধরতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিচ্ছি কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলে তা প্রতিরোধে কোন প্রভিশন নেই। পরিবর্তন নিজ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। মিডিয়াতে জেন্ডার বৈষম্যমূলক কনটেন্ট প্রচার বন্ধ করতে কর্পোরেট সেক্টর ও মোবাইল কোম্পানিকে যুক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে।’
ওয়েবিনারের শেষ অংশে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কর্মজীবী নারী থেকে হাসিনা আক্তার, আইইডি থেকে সঞ্চিতা তালুকদার, এডাব থেকে সমাপিকা হালদার, গণসাক্ষরতা অভিযান থেকে শামসুন নাহার, নারী ঐক্য পরিষদ থেকে লুৎফুন নেসা খান, পল্লীমা মহিলা পরিষদ থেকে অ্যাড. নীলাঞ্জনা।
আরেক সংসদ সদস্য শবনম জাহান ৮ মার্চের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘দিবসটির মাধ্যমে এই আন্দোলনের ফসল আমরা প্রতিবছর উদযাপন করি এবং প্রতিবছরই নতুন নতুন দাবি উঠে আসছে। দাবিগুলো অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে, আর যে দাবিগুলো পূরণ হয়নি তা বাস্তবায়নে সরকার ও সামাজিক শক্তিকে একসাথে কাজ করতে হবে।’
ওয়েবিনারের মডারেটরের বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন বলেন, ‘নারী আজ অত্যন্ত জাগরিত একটি শক্তি। এই জাগরণকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আগামী দিনের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে তরুণ প্রজন্মকে বায়াস ব্রেকিংয়ের কাজটি করতে হবে। কিছু পরিবর্তন হচ্ছে তবে তার কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিতের জন্য আইনগত কাঠামো তৈরি করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্ত করতে হবে এবং সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর দাবি যুক্ত করতে নারী রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নারীর জীবনে চলমান নানামুখী সহিংসতা দূর করা নারী আন্দোলনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, একে মোকাবিলা করে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
পাশাপাশি তিনি এ আন্দোলনে নারী সাংসদদের সর্বোতভাবে পাশে থাকার আহ্বান জানান। এ ছাড়াও সাইবার দুনিয়াকে কিভাবে নারী আন্দোলনের কাজে ব্যবহার করা যায় তা আমাদের নিয়ে ভাববার ও যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়ারও আহ্বান জানান।
সারাবাংলা/আরএফ/একে