কুয়াকাটার পতিত জমি-বালুর ঢিবিতে আগাম তরমুজ চাষে সফলতা
১২ মার্চ ২০২২ ১২:১৩
কুয়াকাটা: সাগর কন্যা কুয়াকাটার বিস্তীর্ণ উপকূলের পতিত জমি, বালুর ঢিবি ও চরের আবাদি জমিতে দিনের পর দিন বাড়ছে রসালো ফল তরমুজের চাষ। স্বল্প খরচে অধিক লাভ পাওয়ায় আগাম তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। অনুকূল আবহাওয়ায় আগাম চাষেও মিলেছে বাম্পার ফলন। চাষিরা পাচ্ছেন উচ্চ বাজার মূল্য।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরমুজের বীজবপন ও উৎপাদন মৌসুম শুরু হয় মূলত ফেব্রুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আবহাওয়া তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। বীজ বপনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস সর্বোত্তম। আগাম ফলন পেতে হলে জানুয়ারি মাসে বীজ বুনে শীতের হাত থেকে কচি চারা রক্ষার ব্যবস্থা ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের কিছু কৃষক নভেম্বরে বীজ বপন করেন। নভেম্বরে যে সকল জমিতে তরমুজ চাষ করেন তা মূলত পতিত বালুর ঢিবি ও বালুরচর। এ জমিতে অন্য কোনো ফসলের চাষ করেন না তারা।
তারা জানান, তরমুজ চাষের উপযুক্ত মৌসুম ফেব্রুয়ারি মাসে মূলত ফসলি জমিতে চাষ করা হয়। আগাম তরমুজ চাষে কঠোর পরিশ্রম হলেও ফলন ভালো, বাজারে চাহিদা ভালো। বেশি লাভজনক হওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় দিনদিন বাড়ছে রসালো মৌসুমি ফল তরমুজের চাষ।
এলাকার তরমুজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমেও আগাম চাষে মিলেছে বাম্পার ফলন। মৌসুমের তিন মাস আগে তরমুজ বাজারে আসায় চাষিরাও পেয়েছেন উচ্চমূল্য। তারা বলছেন, মিষ্টি পানির সংরক্ষণ বাড়ানো গেলে এক মৌসুমে এখাত থেকেই আয় হতে পারে হাজার কোটি টাকা।
কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বদিকে সূর্যোদয় পয়েন্টের বালুরচরে ১৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করছেন আল-আমিন। সরেজমিনে আল-আমিনের ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতের পাশে পাকা তরমুজ কেটে দুইটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ট্রলি গাড়ি এসে থামে তরমুজের স্তূপের পাশে।
কৃষক আল-আমিন জানালেন, তিনি একাই ৪ ধাপে ১৬ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। প্রথম ধাপে লাগানো ক্ষেত থেকে বড়-মাঝারি সাইজের ১ হাজার তরমুজ ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করেছেন। এই ক্ষেতে পুনরায় সার-কিটনাশক প্রয়োগ ও পানি সেচ করে পরিচর্যা করবেন। পুরানো লতায় আবার নতুনের মতো ফল আসবে। কারণ এখনই তরমুজ চাষের উপযুক্ত সময়। দ্বিতীয় ধাপে লাগানো ক্ষেতের তরমুজ চলতি মাসের শেষের দিকে বিক্রি করতে পারবেন। তৃতীয় ধাপে ক্ষেতে ফুলে-ফলে ছেয়ে গেছে লতা। শেষ ধাপের ক্ষেতে এখনও ফুল আসেনি। লতায় ছেয়ে গেছে পুরো ক্ষেত।
আল-আমিন বলেন, ১৬ বিঘা জমিতে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন তিনি। আরও দুই লাখ টাকা বিক্রির আশা আছে। আল-আমিনের ক্ষেতের উত্তরপাশে ১০ একর জমিতে তরমুজ চাষ করছেন আবদুর রহমান। তিনি ক্ষেতের লতায় বালাইনাশক প্রয়োগ করছিলেন।
কথায় কথায় আবদুর রহমান জানান, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বীজ বপন করেছেন। আগামী এপ্রিলে তার ক্ষেতের তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন। তার ক্ষেতের অবস্থা খুবই ভালো।
তিনি বলেন, আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে আছে। শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে দ্বিগুণ লাভ হবে।
আল-আমিনের ক্ষেত থেকে এক হাজার তরমুজ কিনছেন ব্যবসায়ী মো. সোবাহান মিয়া। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আগাম তরমুজের বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। কাউয়ারচর এলাকায় আগাম তরমুজের চাষ বেশি হয়। ওই এলাকার জমি আগাম তরমুজ চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
বেড়িবাঁধের বাইরে পাশাপাশি ক্ষেতে তরমুজ চাষ করেছেন মো. রায়হান, আ. সোবাহান ও আ. কুদ্দুস। তারা প্রত্যেকে ক্ষেত থেকে তরমুজ বিক্রি করেছেন। তাদের ক্ষেতে এখনও বেশ কিছু ছোট কাচা তরমুজ এবং লতার ডগায় ফুল আছে। তারা ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। কৃষক আ. সোবাহান বলেন, আগাম তরমুজ দিয়েছি। ফলও বেশ ভালো পেয়েছি। কিন্তু পানির সমস্যা আছে। বহু দূর থেকে পানি আনা কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। সরকারিভাবে পানির সুব্যবস্থা করলে আমাদের কৃষকদের জন্য ভালো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় লতাচাপলী ও ধুলসার ইউনিয়নে। এছাড়া ডালবুগঞ্জ, নীলগঞ্জ, মহিপুর, মিঠাগঞ্জেও তরমুজের চাষ হয়। উপজেলায় ব্লাক বেঙ্গল, ড্রাগন ও গ্লোরি প্রজাতির তরমুজ চাষ করা হয়েছে।
চাষিরা জানান, তাদের ক্ষেতের তরমুজ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকে কিনে নেন। এবারও কিনছেন। ধাপে ধাপে তৈরি করা তরমুজ ক্ষেতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। তারা ধান চাষের অনুপযোগী জমি, নদীর জেগে ওঠা চর কিংবা জমি বর্গা নিয়ে তিন প্রজাতির তরমুজ চাষ করছেন। কোনো সরকারি প্রণোদনা ছাড়াই তারা দেশীয় পদ্ধতিতেই তরমুজ চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের আর্থিক সহযোগিতা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করলে আরও লাভবান হওয়া যেত বলে মনে করেন কৃষকরা।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ এম আর সাইফুল্লাহ বলেন, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উন্নত জাতের তরমুজ আগাম চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ যাতে না করে সে বিষয়েও মাঠপর্যায়ে তদারকি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আধুনিক চাষেও উদ্বুদ্ধ করি। কোন সার, কোন মাটি তরমুজের জন্য উপযোগী, সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে উপজেলায় আগাম ২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
সারাবাংলা/এএম