কমছে জনশক্তি রফতানি, শ্রমবাজার ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ
১৫ মার্চ ২০২২ ২৩:৫২
ঢাকা: স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। শুরুটা ছয় হাজার কর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে হলেও বছর দশেকের মধ্যেই বিশ্বে জনশক্তি রফতানিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিজের অবস্থান অনেকটাই পাকা করে নিয়েছিল। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদারও পরিবর্তন আসে শ্রমবাজারে, যেখানে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখা দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষ শ্রমিকের অভাব, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, ফ্রি ভিসার ফাঁদ, সিন্ডিকেট ও দালালদের দৌরাত্মে এক সময়ের বড় শ্রমবাজারগুলোর অনেকটাই বন্ধই হয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম, দুর্নীতি কমানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষ করে না পাঠালে বাকি বাজারগুলোও ধরে রাখা কঠিন হবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ১৬৮টি দেশে কাজ নিয়ে যান বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী যায়। যার শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। এর পরেই রয়েছে ওমান, কাতার, জর্ডান, সিঙ্গাপুর। সরকারিভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে লোক নিয়োগ বন্ধ থাকলেও ফ্রি ভিসাসহ অন্য উপায়ে দেশটিতে কর্মী যাচ্ছে। আর এক সময় বাহরাইন, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো বিপুল সংখ্যক লোক নিয়োগ দিলেও এখন অনেক কমে গেছে। তবে সরকারিভাবে বন্ধের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর রয়েছে মালয়েশিয়ার মতো বড় শ্রমবাজার।
বিএমইটির তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন শ্রমিক পাঠানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি। তবে নব্বইয়ের দশকে জনশক্তি রফতানিতে দেশটিতে যে গতি পায় তা আর থামেনি। এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে দেশটিতে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন কর্মী কাজ নিয়ে যান। আর ২০২১ সালে গেছেন ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন। এছাড়া গত দুই মাসে গিয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৮৭ জন। সব মিলিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪২ জন কর্মী। যা মোট জনশক্তি রফতানির ৩৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এরপরে রয়েছে ওমান। গত ১০ বছর থেকে দেশটিতে প্রায় একই গতিতে কর্মী পাঠানোর ধারা অব্যাহত রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে যখন অনেক দেশই কর্মী নিয়োগ বন্ধ রাখে তখনও ওমান বাংলাদেশ থেকে ২১ হাজার ৭১ জন কর্মী নেয়। ২০২১ সালে দেশটিতে যায় ৫৫ হাজার ৯ জন। আর গত দুই মাসে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী ওমান যায়। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ ৭৬ লাখ ৯৫০ জন কর্মী কাজ নিয়ে যান। যা মোট জনশক্তি রফতানির ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। কাতারে এখন পর্যন্ত কর্মী গেছেন ৮ লাখ ২১ হাজার ৮৫৬ জন, কুয়েতে গত ৪৫ বছরে গেছেন ৬ লাখ ৩২ হাজার ৭২২ জন কর্মী। যা মোট জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ৬ শতাংশ। গত তিন বছর ধরে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর গতি কমলেও গেল বছর থেকে বেড়েছে। ২০২০ সালে দেশটিতে যেখানে ১০ হাজার কর্মী পাঠানো গেছে সেখানে ২০২১ সালে গেছে ২৭ হাজার ৮৭৫। আর চলতি বছরের দুই মাসে গিয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কর্মী। বর্তমানে জনশক্তি রফতানিতে জর্ডানে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। করোনা মহামারিতে সাড়ে তিন হাজার কর্মী পাঠানো গেলেও ২০২১ সালে দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছে ১৩ হাজার ৮১৬ জন কর্মী। আর চলতি বছরের দুই মাসে গেছেন ২ হাজার ২৭ জন। মূলত বর্তমানে এসব দেশে বেশি কর্মী যাচ্ছে।
এছাড়াও লেবানন, লিবিয়া, সুদান, কুয়েত, সাউথ কোরিয়া, ইতালি, ব্রুনাই, মিশর, মরিশাস, মালয়েশিয়া, জাপান, ইরাক ও যুক্তরাজ্যে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক যান। যদিও গত দুই বছর ধরে এই দেশগুলোতে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা হাজারের ঘর ছুঁতে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে যে কয়েকটি বড় শ্রমবাজার ছিল তারমধ্যে অন্যমত সংযুক্ত আরব আমিরাত। এক সময় সবচেয়ে চাঙ্গা শ্রমবাজার ছিল দেশটি। ১৯৭৬ সালে যেখানে প্রায় দুই হাজার কর্মী পাঠিয়ে জনশক্তি রফতানি শুরু করা হয়, সেখানে ২০১২ সালে পাঠানো হয় ২ লাখ সাড়ে ১৫ হাজার। বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজারটিতে ১৯৭৬ সালের পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭৬ হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। বর্তমানে দেশটিতে ১০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত।
জানা যায়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে ইউএই। বর্তমানে দেশটিতে কর্মী যাচ্ছে। তবে তা সরকারি প্রক্রিয়ায় নয়। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের পর অন্যতম বড় শ্রমবাজার ছিল মালয়েশিয়া। সেখানেও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটের অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশটিতে ওই বছর ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন কর্মী পাঠানোর পর আর সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়ায় এ পর্যন্ত অর্থাৎ গত ৪৫ বছরে কর্মী পাঠানো গেছে ১০ লাখ ৫৭ হাজার ২৪৯ জন। সম্প্রতি দেশটিতে কর্মী পাঠাতে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার। সেখানে নানা বাধার মুখে পড়ে এখনো প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। কবে কর্মী পাঠানো শুরু হবে তার নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না কেউ।
বাংলাদেশিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজারগুলো বন্ধ থাকায় হতাশ বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকরা। তাদের আশা, সরকার এই বছর শ্রমবাজার খুলতে পদক্ষেপ নেবে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে একমাত্র ভরসা সৌদি আরব। ইউই খোলার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও সফল হওয়া যায়নি। মালয়েশিয়া খোলার দ্বারপ্রান্তে এসে আটকে রয়েছে। এছাড়া মহামারি করোনায় গেল দুই বছর। এখনই উদ্যোগ না নিলে যেগুলো খোলা রয়েছে সেসব শ্রমবাজারও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ১ কোটি ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার ৪২৮ জন কর্মী। এদের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো শ্রমবাজারে মন্দা এবং নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ না করতে পারায় দিনকে দিন কর্মী পাঠানো কমেছে। এরমধ্যে গেল দুই বছর করোনার প্রভাবে একদিকে কর্মী পাঠানো যায়নি, অন্যদিকে উল্টো কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন। আর এই সময়ে জনশক্তি রফতানি ঠেকেছে একদম তলানিতে। এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে প্রবাসী আয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে। চলতি বছর শ্রমবাজারগুলো মন্দ-খারাপের দোলাচলে থাকবে বলে জানিয়েছে আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।
সংস্থাটির ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক পূর্বাভাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২২ সালেও পিছিয়ে থাকবে অর্থনীতি। আর কর্মঘণ্টাও কমবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, ২০২০ সালে মহামারি শুরু সময়ের তুলনায় পৃথিবী অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে বৈশ্বিক কর্মঘণ্টা ২০১৯ সালের তুলনায় ২ শতাংশ কম থাকবে। আর এর প্রভাব বিশ্ব শ্রমবাজারে কম-বেশি পড়বে।
এই পরিস্থিতিতে বন্ধ থাকা শ্রমবাজার খোলার চেষ্টার পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে গ্রিসসহ বেশ কয়েকটি দেশে কর্মী পাঠাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমঝোতা স্মারকে সইও করা হয়েছে। আরও জানা যায়, বর্তমানে বৈধভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বলিভিয়ায় কর্মী যেতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম সারাবাংলা বলেন, ‘শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে যে শ্রমিক যে ক্যাটাগড়িতে যেতে চান, সেভাবে তাকে জ্ঞান ও ধারণা দেওয়া হচ্ছে।’ এসব শ্রমিকেরা শ্রমবাজারে গিয়ে অনায়াসে টিকে থাকতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত দুই বছরের ধকল কাটিয়ে গতি ফিরতে শুরু করেছে জনশক্তি রফতানিতে। যদিও জানুয়ারিতে যে সংখ্যক কর্মী গেছেন, ফেব্রুয়ারিতে তার থেকে কিছুটা কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনাময় মালয়েশিয়া বাজার খুলে দিতে পারলে এবছর গত পাঁচ বছরের চেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো যাবে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম
ওমান কুয়েত চ্যালেঞ্জ জনশক্তি রফতানি মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সৌদি আরব