‘সিন্ডিকেটের কারসাজি’, পাইকারিতে হঠাৎ কমছে তেল-চিনির দাম
১৮ মার্চ ২০২২ ১৩:০০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে রমজানের অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচিত কয়েকটি পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা এবং পেঁয়াজ, রসুন ও আদা। শবে বরাতের আগ মুহূর্তে এসে হঠাৎ ক্রেতা কমেছে পাইকারি বাজারে। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বেশি থাকায় মজুত পণ্য দ্রুত বিক্রির জন্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অস্থির হয়ে আছে ভোজ্যতেলের বাজার। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মনিটরিং সেলের হিসেব অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম ৩৮ শতাংশ আর পাম তেলের দাম ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। চড়তে থাকা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ হারের ভ্যাট তুলে নেওয়ার কথা গত ১০ মার্চ জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এরপর পরিশোধন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং সয়াবিন তেল ও পাম তেলের আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সরকার।
দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতনুগঞ্জে বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) সয়াবিন তেল মণপ্রতি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, পামঅয়েল ৫ হাজার ৫০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ৫ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। একই বাজারে পাইকারি পর্যায়ে চলতি সপ্তাহের শুরুতে সয়াবিন তেল মণপ্রতি ৬ হাজার ১০০ টাকা, পামঅয়েল ৫ হাজার ৪০০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
ভোজ্যতেলের পাইকারি বিক্রেতা খাতুনগঞ্জের মেসার্স আব্বাস সওদাগরের ব্যবস্থাপক জাফর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার পর খোলা তেল মণপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কমে গেছে। পামঅয়েল যদিও বুধবার ২০০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরদিনই ৩০০ টাকা কমেছে। সুপার সয়াবিন মণপ্রতি ২০০ টাকা কমেছে। ভ্যাট প্রত্যাহারের পর কারখানা থেকে দর পুনঃনির্ধারণের কোনো চিঠি আমরা পাইনি। কিন্তু এর আগেই আমাদের দাম কমিয়ে দিতে হয়েছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রেতা কমে গেছে।’
চাক্তাই-খাতনুগঞ্জে বৃহস্পতিবার মণপ্রতি চিনি বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৬৪৫ টাকায়। চলতি সপ্তাহের শুরুতে ৪০ টাকা বেশি বিক্রি হয়েছিল। চিনির পাইকারি বিক্রেতা আলতাফ অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আলতাফ এ গাফফার বলেন, ‘চিনির দাম কিন্তু বাড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারেও কম ছিল, দেশের বাজারেও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এই সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে চিনির দাম কমেছে। এর প্রভাব দেশের বাজারেও পড়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যারা ভোজ্যতেলের ক্রেতা, তারা একইসঙ্গে চিনিরও ক্রেতা। ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে। একইসঙ্গে চিনিরও কমেছে। কারণ ক্রেতা ভোজ্যতেলের সঙ্গে চিনিও কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সেজন্য চিনির দাম কিছুটা কমেছে।’
আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, রমজানে দেশে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা তৈরি হয়। বছরে চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন, যার বড় অংশই আমদানির মাধ্যমে জোগান দিতে হয়। দেশে চিনির চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেন বেসরকারি আমদানিকারকরা। তারপর সেটি পরিশোধন করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই চিনির বাজারে সংকট ছিল, দামও বেড়েছিল। তবে গত ডিসেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে বৃহস্পতিবার সাধারণ ছোলা কেজিপ্রতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গত সপ্তাহে দর ছিল ৬১-৬২ টাকা। ভালো মানের ছোলা ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গত সপ্তাহে ছিল ৬৬-৬৭ টাকা।
ছোলা-ডালের পাইকারি ব্যবসায়ী চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘গতবছর শবে বরাতের আগে ক্রেতা ছিল বেশি। ছোলার দাম কিছুটা বাড়তি ছিল। এবার ক্রেতা কম। তবে রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে ক্রেতা বাড়তে পারে। ক্রেতা বাড়লেও সংকট হবে না। পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। এখন কেজিতে ২-৩ টাকা কমেছে। আরও কমতে পারে।’
কাস্টমস ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, রমজানে দেশে ৭০ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ছোলার চাহিদা থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এর চেয়ে অন্তত ৫০ হাজার মেট্রিক টন বেশি ছোলা দেশে আমদানি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৮ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এক লাখ ৩০ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন ছোলা এসেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসেছে আরও ২৮ হাজার মেট্রিক টন ছোলা।
পাইকারি বাজারে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে পেঁয়াজের। গত সপ্তাহে ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা দরে। সেটা এ সপ্তাহে অন্তত ১৮ টাকা কমে গেছে। বৃহস্পতিবার ভালো মানের ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০ টাকায় এবং এর চেয়ে কিছুটা নিম্নমানের পেঁয়াজ ২৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের কাজী স্টোরের মালিক জাবেদ ইকবাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে কেজিতে ১৫ টাকা কমে গেছে। আমাদের পাইকারিতেও ১৮-২০ টাকা কমে গেছে। পেঁয়াজ পচনশীল। আমরা তো দাম ধরে বসে থাকতে পারব না। পেঁয়াজ আমদানিতে এখন কোনো সমস্যা নেই। দেশেও ভালো ফলন হয়েছে। এজন্য পেঁয়াজে এখন কোনো সংকট নেই।’
বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে আদা প্রতিকেজি গত সপ্তাহের চেয়ে অন্তত ১০ টাকা কমে ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রসুন কেজিতে অন্তত ২৫ টাকা কমে ৯৫-৯৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রতিবছর রমজান উপলক্ষে শবে বরাতের আগে যেভাবে বাজারে ক্রেতার সমাগম ঘটে, এবার সেভাবে ক্রেতা আর আসবে না। একসঙ্গে বেশি পণ্য কিনে মজুতের দিকে এবারে ক্রেতার আগ্রহ কম। ক্রেতাদের বাজারমুখী করতেই দাম কমানো হচ্ছে— ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাইকারি বাজারে কিছু পণ্যের দাম কমেছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের দামটা হঠাৎ পড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা দাম কমালেও নিশ্চয় লোকসান দিয়ে তাদের পণ্য বিক্রি করছেন না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে— বাজারে সংকটের সময় কেন তারা এই দামে পণ্য বিক্রি করেন না? কেন সরবরাহ সংকট থাকে? তাহলে বোঝা যায়, পণ্যের সরবরাহ সংকট এবং বাড়তি দাম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির ফল। তারাই কারসাজি করে সরবরাহ সংকট তৈরি করে, তারাই আবার কারসাজি করে দাম বাড়ায়।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর