‘প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমরা এখনো পাইনি’
১৮ মার্চ ২০২২ ১৭:৪১
ঢাকা: পাঁচ দশকে দেশ অনেকটা এগিয়ে গেলেও এখনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমরা অর্জন করতে পারিনি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে সত্য, কিন্তু সমসুযোগ ও সুশাসন বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে স্বাধীনতার মূলনীতি থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমরা এখনো পাইনি। কেবল ভোটেই গণতন্ত্র নয়, সমসুযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তাই হল প্রকৃত গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র থেকে আমরা অনেক দূরে রয়েছি।
শুক্রবার (১৮ মার্চ) এফডিসিতে ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি স্বাধীনতা দিবস বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০২২’-এর গ্র্যান্ড ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. গণেশ চন্দ্র সাহা।
দেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রার পথে ক্ষমতালিপ্সাকেই প্রধান সমস্যা মনে করছেন শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পক্ষ*বিপক্ষের চেয়েও বর্তমানে বড় সমস্যা হলো ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসিকতা। স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে দেশপ্রেম ছিল, আজ সে দেশপ্রেম নেই। আজ কেবল আত্মপ্রেম। আজ সমাজের উন্নয়ন হচ্ছে না, হচ্ছে ব্যক্তির উন্নয়ন। যখনই সমাজে বিপদ আসছে তখনই ধনীদের আরও উন্নয়ন হচ্ছে।
আরও পড়ুন- স্বাধীনতা পুরস্কার থেকে বাদ পড়লেন আমির হামজা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক আরও বলেন, উন্নয়ন মানে কেবল দালানকোঠা ও রাস্তাঘাট গড়া নয়, উন্নয়ন হলো মেধাকে মুক্ত করা ও মেধার বিকাশ। আজ বিশ্ববিদ্যালয়েও গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, ছাত্র সংসদ নেই, সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলা নেই। ফলে ছাত্রদের মেধার বিকাশ হচ্ছে না। তারা বিপথগামী হচ্ছে।
তিনি বলেন, আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো— আমাদের সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুধু সম্পদ নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মেধাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশে উপযুক্ত মূল্যায়ন না হওয়ায় আমাদের মেধাবী সন্তানেরা বিদেশে গিয়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, দেশ তাদের সেবা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীন হলেও পাকিস্তানের মতো পুঁজিবাদ ও আমলাতান্ত্রিকতা থেকে আমরা এখনো পুরাপুরি মুক্ত হতে পারিনি।
চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় সাহিত্য বিভাগে মরহুম আমির হামজার স্থান পাওয়া সমালোচনার জন্ম দেয় দেশব্যাপী। এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চলতি বছর (সাহিত্য বিভাগে) উপযুক্ত ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, যা আমাদের জন্য লজ্জার। এই পুরস্কার প্রদান আমাদের ছোট করেছে। তাই সরকারের কাছে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।
শুক্রবার বিকেলে অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেই তালিকায় জায়গা পাননি আমির হামজা। অর্থাৎ এই পুরস্কার তিনি পাচ্ছেন না।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নিয়েও কথা বলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ রাজাকারদের প্রকৃত তালিকা করা। রাজাকার ছাড়া বাকি সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এটি ছিল জনযুদ্ধ। তাই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে যারা, মুক্তিকামী বাঙালিকে যারা ধরিয়ে দিয়েছে— এমন ব্যক্তিদের তালিকা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বের হয়ে আসবে।
এদিকে, সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে শুধু রাজনৈতিক মুক্তি পেলেই চলবে না, দরকার সামাজিক, অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ সহ বৈষম্যহীন, অসম্প্রদায়িক ও ন্যায় বিচারভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা। তাহলেই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য যারা রাজনীতি করে তারা জনগণের বন্ধু হতে পারে না। তেমনি যারা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে, তারাও জনগণের বন্ধু নয়। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি ঘটলে স্বাধীনতার স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার চেতনা বৃথা যায়। মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের আত্মা কষ্ট পায়। তাই জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনে সরকার ও বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
কিরণ আরও বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে এই মূহর্তে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। ভবিষ্যত নির্বাচন কাঠামো কী হবে, তা নিয়ে রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা অবশ্যক। এই সংলাপ আয়োজনে সরকারকে এগিয়ে এসে ভবিষ্যত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। কারণ এরই মধ্যে আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশনের ডাকা প্রথম সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে।
সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার ঘিরে বিতর্ক নিয়ে কথা বলেন কিরণও। তিনি বলেন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ প্রায় কোনো বিশিষ্টজনই আমির হামজা নামক ওই ব্যক্তির বই পড়েননি বা তার সম্পর্কে জানেন না। এর আগে ২০২০ সালেও রইজ উদ্দিন নামক একজনকে সাহিত্যে স্বাধীনতার পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করা হলো। পরে নানা সমালোচনায় তাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদানে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিহারের জন্য এর নির্বাচন প্রক্রিয়া বদলানো উচিত।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠেয় প্রতিযোগিতায় বিতর্কের বিষয় ছিল ‘বিরোধী রাজনীতির দেশপ্রেমের অভাবেই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে’। এতে সরকারি সরকারি দল হিসেবে ঢাকা সিটি কলেজ ও বিরোধী দল হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ অংশ নেয়। ঢাকা সিটি কলেজকে পরাজিত করে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের বিতার্কিকরা চ্যাম্পিয়ন হন।
চ্যাম্পিয়ন দলের বিতার্কিকদের নগদ ৫০ হাজার টাকা ও রানার-আপ দলকে নগদ ৩০ হাজার টাকাসহ ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, ড. মোহাম্মদ শাহ আলম চৌধুরী ও সাংবাদিক পার্থ সঞ্জয়।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
আমির হামজা টপ নিউজ ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাধীনতা পুরস্কার