ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ ফ্যামিলি কার্ড!
২০ মার্চ ২০২২ ২০:৩৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ন্যায্য মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির জন্য চট্টগ্রামে বিতরণ করা সোয়া পাঁচ লাখ ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে পৌনে দুই লাখ পেয়েছেন নগরীর বাসিন্দারা। সিটি করপোরেশন এলাকায় এসব ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজস্ব বিবেচনা ছাড়া অন্য কোনো তদারকি ছিল না।
রোববার (২০ মার্চ) ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রির প্রথম দিনে ক্রেতার সারিতে গরীব-হতদরিদ্রদের চেয়েও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন বেশি চোখে পড়েছে। তবে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বলেছেন, ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম কিংবা নিজস্ব পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। আর কার্ড বিতরণে কোনো অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের জেল রোডে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে পণ্য কেনেন বদরপাতি এলাকার বাসিন্দা মো. ইউছুপ, যিনি নৈশপ্রহরী হিসেবে কর্মরত। ইউছুপ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি কোনোদিন টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য নেননি। তবে করোনার সময় ত্রাণ পেয়েছিলেন।
নগরীর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের বান্ডেল রোডের বাসিন্দা খাতনগঞ্জের আড়ত কর্মচারি কানু ভৌমিক জানিয়েছেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে তার ভালো জানাশোনা আছে। কাউন্সিলর তাকে ডেকে নিয়ে কার্ড দিয়েছেন।
কার্ড কীভাবে বিতরণ হয়েছে— জানতে চাইলে কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাউন্সিলরদের প্রত্যেককে সাড়ে চার হাজার এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের তিন ওয়ার্ডের জন্য আরও সাড়ে চার হাজার কার্ড দেওয়া হয়েছিল। আমরা যাচাই-বাছাই করে কার্ডগুলো বিতরণ করেছি। তবে এবার এমন কোনো স্তর ভাগ করে দেওয়া হয়নি যে সব কার্ড শুধু দরিদ্র বা বস্তিবাসীকে দিতে হবে। আমরা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তদেরও কার্ড দিয়েছি। কার্ড সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে বিতরণ হয়েছে। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে, তবে কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে বড় কোনো অনিয়ম হয়নি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকায় একেবারে প্রান্তিক লোকজনকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। যারা রাস্তায় বসে মাছ বিক্রি করে, ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে তাদের কার্ড দিয়েছি। আবাসিক এলাকার লোকজন, যারা ১০-১৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন, তাদের আমরা কোনো কার্ড দিইনি। এতটুকু বলতে পারি— কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতি করা হয়নি। পাড়া-মহল্লায় আমাদের মুরব্বি যারা আছেন, তাদের মতামত নিয়ে কার্ড দেওয়া হয়েছে।’
তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
রোববার সকালে নগরীর ষোলশহর এলাকায় একটি কনভেনশন সেন্টারে পণ্য বিক্রির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এসময় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধন শেষে মেয়র রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সামনে রমজান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে নায্য মূল্যে খাদ্যপণ্য বিতরণ শুরু হয়েছে। মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। শুক্রবার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত নেওয়া হয়। যেসব ওয়ার্ডে লোকসংখ্যা বেশি, সেখানে আরও কার্ড দেওয়া হবে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কার্ড বিতরণে যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাই, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ১৫ উপজেলার ১৯১টি ইউনিয়নে এবং ১৫ পৌরসভায় একযোগে ফ্যামিলি কার্ডে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়। মোট ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮২ জন ফ্যামিলি কার্ড পেয়েছেন। এর মধ্যে নগরীতে ৩ লাখ ৯৬৩ পরিবার, উপজেলাগুলোতে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪৯ এবং পৌরসভাগুলোতে ৪৭ হাজার ৬৭০ পরিবার এ সুবিধা পাচ্ছে।
মোট ৮৪ জন ডিলারের মাধ্যমে প্রত্যেক কার্ডধারীর কাছে ২ কেজি করে চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল বিক্রি করা হচ্ছে। চিনি প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৬৫ টাকা এবং সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনটি পণ্যের একটি প্যাকেজ হিসেবে একজন কার্ডধারীকে মোট ৪৬০ টাকার পণ্য কিনতে হচ্ছে।
আগামী ৩০মার্চ পর্যন্ত রমজানের প্রথম পর্বের পণ্য বিক্রি চলবে। দ্বিতীয় পর্বের বিক্রি শুরু হবে আগামী ৩ এপ্রিল।
এদিকে, দেশব্যাপী বিশেষ কার্ডে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘টিসিবির বিশেষ কার্ডে পণ্য বিক্রির কার্যক্রমটি রমজানের শেষ পর্যন্ত চালু রাখার অনুরোধ করছি। এই কার্যক্রম যেন কেউ নস্যাৎ করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পেলে যেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সরকারের যেকোনো মহৎ উদ্যোগেকে নস্যাৎ করতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে দুষ্টচক্র। তাদের চক্রান্ত কোনোভাবেই সফল হতে দেওয়া যাবে না।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর