Monday 30 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চুক্তির নিবন্ধন থাকলে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে বাড়তি সময় মিলবে

সারাবাংলা ডেস্ক
২১ মার্চ ২০২২ ০০:৪৯

সব ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে চুক্তির নিবন্ধন থাকলে বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন— সাধারণভাবে অনিবন্ধিত চুক্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলে চুক্তিভঙ্গের তিন বছরের মধ্যে মামলা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু চুক্তিটি যদি নিবন্ধিত হয়, তাহলে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার জন্য ছয় বছর পর্যন্ত মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।

আইনি পরামর্শ বিষয় সারাবাংলার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস পাওয়ারড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক‘ অনুষ্ঠানে আইনজীবীরা এসব কথা বলেন। ‘চুক্তি আইন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি সারাবাংলার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

বিজ্ঞাপন

ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদি হাছান চৌধুরী। বিশেষ আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার আসিফ বিন আনওয়ার। ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস’ সঞ্চালনা করেন ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।

চুক্তি আইন বিষয়ক এই আলোচনায় চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রতিকার চাইতে গেলে কত দিনের মধ্যে মামলা করতে হবে— এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আসিফ বিন আনওয়ার বলেন, চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে একাধিক রকম প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। কী ধরনের প্রতিকার চাইবেন, তার ওপর নির্ভর করবে কত দিনের মধ্যে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে গেলে এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। সেক্ষেত্রে চুক্তিটি নিবন্ধিত হতে হবে।

বিজ্ঞাপন

উদাহরণ দিয়ে ব্যারিস্টার আসিফ বলেন, কেউ হয়তো কোনো জমি কেনার জন্য বায়না চুক্তি করেছেন। সেই চুক্তির আওতায় জমির জন্য নির্ধারিত মূল্যের একটি অংশ পরিশোধ করেছেন, বাকি অংশ পরে পরিশোধের পর নিবন্ধন করে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। এ ধরনের চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে প্রতিকার চাইতে গেলে চুক্তিভঙ্গের এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, বায়না চুক্তিটি যদি নিবন্ধন করা হয়ে না থাকে, তাহলে কিন্তু এই আইনে প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলে করণীয় তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, কেউ যদি চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চান, তাহলে অনিবন্ধিত চুক্তির ক্ষেত্রে সময় পাবেন তিন বছর। এক্ষেত্রে চুক্তিটি নিবন্ধন করা থাকলে তিনি বাড়তি সুবিধা পাবেন— মামলা করার জন্য সময় পাবেন ছয় বছর।

ভূমি সংক্রান্ত ক্রয় বিষয়ক চুক্তির বিষয়ে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদি হাছান চৌধুরী বলেন, ল্যান্ড প্রোপার্টি বা জমিজমা কেনার ক্ষেত্রে সেই জমির অবস্থান ঠিক কোথায়, সেটি ক্রেতাকে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হবে। ঢাকায় হলে জমি রাজউকের এলাকার মধ্যে হতে পারে, গণপূর্ত বা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধীন হতে পারে। আবার বসুন্ধরা বা আফতাবনগরের মতো প্রাইভেট এরিয়াতেও হতে পারে। রাজউক বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের অধীন জমি হলে সেগুলো হস্তান্তরের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো হস্তান্তরের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হতে পারে। আবার প্রাইভেট এরিয়ার ক্ষেত্রেও তাদের নিজ নিজ সোসাইটির কিছু বাইলজ থাকতে পারে। সেগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।

নিবন্ধনের গুরুত্ব তুলে ধরে ব্যারিস্টার মেহেদি বলেন, ভূমি কেনার ক্ষেত্রে যেকোনো চুক্তির নিবন্ধন করতে হবে। সেটি না করলে চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষা মিলবে না। আবার চুক্তির পর চুক্তিতে উল্লেখ করা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ভূমির স্বত্ব নিয়ে আইনি লড়াই করা যাবে না। আবার রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জমির ক্ষেত্রে সেগুলো হস্তান্তরের যেসব পূর্বশর্ত রয়েছে, সেগুলো অনুসরণ না করে চুক্তি করলে সেই চুক্তির নিবন্ধন থাকলেও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।

ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে সাধারণত ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। সেক্ষেত্রে যে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন, সেই অংশের জন্য ডেভেলপার কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ নিয়েছে কি না, সেটি জানতে হবে। ডেভেলপারের যদি জমি বা সেই অংশের জন্য ঋণ নেওয়া থাকে, তাহলে সেই ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ডেভেলপারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ফলে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে (আরজেএসসি) খোঁজ নিতে হবে, ওই সম্পত্তির ওপর কোনো ধরনের অভিযোগ রয়েছে কি না।

ভূমি এবং ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে চুক্তির আগে আইনজীবীদের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যারিস্টার মেহেদি বলেন, জমির ক্ষেত্রে রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের শর্ত রয়েছে কি না কিংবা ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ধরনের খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে, এগুলো সম্পর্কে আইনজীবীদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ কেউ হয়তো তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি সম্পত্তি কিনতে চান। সেই সম্পত্তির মূল্যমান হয়তো কোটি টাকা। এ বিষয়ে আইনজীবীর পরামর্শ নিতে গেলে হয়তো ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। সেই খরচটুকু করলে কিন্তু বিনিয়োগ অনেকটাই নির্ভার হবে। কিন্তু সেই ২০ হাজার টাকা বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শটুকু না নিলে পুরো বিনিয়োগটিই হুমকির মুখে পড়তে পারে।

https://www.facebook.com/Sarabangla.net/videos/486502016520228

জমিজমা ছাড়া অন্য যেকোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রেও চুক্তি অথবা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে বলে জানান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদি। তিনি বলেন, কেউ হয়তো একটি গাড়ি কিনছেন। এই কেনাকাটায় অর্থ পরিশোধের তথ্যপ্রমাণ রাখতে হবে। চেক বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা দিলে সেটি শক্ত প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে। অনেকের ক্ষেত্রে ‘হোয়াইট মানি’ (বৈধ উপার্জন) না থাকলে ‘ব্ল্যাক মানি’ (যে উপার্জনের বৈধ ঘোষণা নেই) দিয়ে নগদ অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। সেক্ষেত্রেও অর্থ লেনদেনের প্রমাণ রাখতে হবে। সাক্ষী রেখে বা ছবি তুলে সেই প্রমাণ রাখা যেতে পারে। কারণ প্রমাণ না থাকলে গ্রহীতা যদি লেনদেন অস্বীকার করে, তাহলে ক্রেতার খুব বেশি কিছু করার থাকে না। গাড়ির ক্ষেত্রে বিআরটিএতে ওই গাড়ির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অভিযোগ রয়েছে কি না, সেটিও যাচাই করে নিতে হবে।

অনুষ্ঠানে এক জন দর্শক যুক্ত হয়ে জানতে চান, তিনি একটি কোম্পানিকে ছয় বছরের জন্য জায়গা ভাড়া দিতে চান। সেক্ষেত্রে কী ধরনের চুক্তি করতে হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আসিফ বলেন, এক বছরের বেশি সময়ের জন্য জায়গা ভাড়া দিতে হলে তার জন্য লিজ বা ইজারা চুক্তি করতে হবে। সেক্ষেত্রে চুক্তি নিবন্ধন করলে আইন অনুযায়ী সব ধরনের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। এই চুক্তি নিবন্ধন না করলে মাসিক চুক্তি আকারে দেখিয়ে কিছু প্রতিকার হয়তো পাওয়া সম্ভব, কিন্তু সব ধরনের আইনি প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হবে না।

এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে ব্যারিস্টার মেহেদি বলেন, ছয় বছরের জন্য জায়গা ভাড়া দিতে চাইলে ‍চুক্তিতে বেশকিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করতে হবে। যেমন— চুক্তিটি কত দিন পর পুনর্মূল্যায়ন করা যাবে, এটি নির্ধারণ করতে হবে। কী কী করলে চুক্তিভঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। কোন পক্ষ কত দিনের নোটিশে চুক্তি শেষ করতে পারবে (কন্ট্রান্ট টার্মিনেশন), সে বিষয়টি ঠিক করতে হবে। অ্যাডভান্স নেওয়া হলে সেটি প্রতি মাসের ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে কি না, চুক্তি শেষ করলে কোনো পক্ষের পাওনা কত দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে— এমন অনেক বিষয়ই স্পষ্ট করতে হবে।

এ ক্ষেত্রেও যথোপযুক্ত আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ দেন ব্যারিস্টার মেহেদি। বলেন, কোনো কমার্শিয়াল কনসার্ন জায়গা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের পরামর্শে খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ই চুক্তিতে যোগ করবে। সেক্ষেত্রে জায়গার মালিকও যদি কোনো আইনজীবীর পরামর্শ নেন, তিনি এসব বিষয়ে মালিকপক্ষের স্বার্থগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া পক্ষ অবশ্যই চুক্তি নিবন্ধন করতে চাইবে। কারণ, আইনে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগটিই বেশি রাখা হয়েছে। ফলে জমির মালিক এ ধরনের ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চুক্তিতে নিশ্চিত করে চুক্তি নিবন্ধন না করতে চাইলেও সমস্যা হবে না।

ব্যাংক বা কোম্পানির শেয়ার ট্রান্সফার বিষয়ক চুক্তির বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদি। বলেন, অনেক সময় যথাযথ চুক্তি না করেই অনেকে কোম্পানি শেয়ার ট্রান্সফার করেন। পরবর্তী সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। সেক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রেতা যিনি, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে করণীয় তুলে ধরে তিনি বলেন, কোম্পানি শেয়ার কেনার সময় জয়েন্ট স্টক রেজিস্ট্রারের সামনে উপস্থিত হতে হতে হবে। শেয়ারের টাকা পে-অর্ডার বা চেকের মাধ্যমে দিলে তার কপি সংরক্ষণ করতে হবে। শেয়ার কেনার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে শেয়ার বিক্রির জন্য ওই কোম্পানির বোর্ডের রেজ্যুলেশন রয়েছে। অনেকেই আবার দেখা যায় কোম্পানির কাগজপত্রে একরকম সই দিচ্ছেন, শেয়ার বিক্রির কাগজে অন্য সই ব্যবহার করছেন। ফলে যে ব্যক্তির সইয়ে কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, তার সই কোম্পানির কাগজপত্রেও একইরকম কি না, সেটিও যাচাই করে নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে তাই কোম্পানি আইনের চর্চা করেন— এমন আইনজীবী বা ল ফার্মের পরামর্শ নেওয়া ভালো হবে।

আলাদা আলাদা কাগজপত্রে একই ব্যক্তির আলাদা আলাদা সই পাওয়া গেলে সেটি আদালতে যাচাই করার সুযোগ আছে কি না— এমন প্রশ্ন রাখেন ব্যারিস্টার আসিফ বিন আনওয়ার। জবাবে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদি হাছান চৌধুরী বলেন, সেই সুযোগও রয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ উঠলে আদালত সই যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিকে পাঠাতে পারেন। দুইটি সই একই ব্যক্তিই করেছেন কি না, সেটি হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট যারা আছেন তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাতে পারবেন।

সারাবাংলা/টিআর

চুক্তি আইন চুক্তি নিবন্ধন টপ নিউজ সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর