Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বামীর পক্ষে দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন যেকোনো ব্যক্তি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ মার্চ ২০২২ ১০:০২

ঢাকা: পরিশোধ না করা পর্যন্ত মুসলিম নারীর দেনমোহর স্বামী ওপর ঋণ বা দেনা হিসেবে থেকে যাবে। একইসঙ্গে স্বামীর পক্ষে যেকোনো ব্যক্তি (বাবা, ভাই বা কোনো আত্মীয় বা অন্য কেউ) দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন। স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

‘জিয়াউল হক ও অন্যান্য বনাম ফারহানা ফেরদৌসী ও অন্যান্য’ শিরোনামে মামলায় বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দেন। ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায়ের ২১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, স্বামীর পাশাপাশি তার পক্ষে তার যেকোনো ব্যক্তি দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন। আর দেনমোহর হিসেবে জমি দেওয়া হলে, তা পাওয়ার জন্য পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন স্ত্রী। অর্থাৎ পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে স্ত্রী সেই জমি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

আদালতে জিয়াউল হকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সুরজিৎ ভট্টাচার্য এবং ফারহানা ফেরদৌসের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম. আলী মুর্তজা।

মামলায় আদালতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ এবং বাইতুল মোকাররমের মুফতি মো. আব্দুল্লাহ ও ইসলামী ফাউন্ডেশনের মুফাসসির ড. মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী। এ মামলায় তারা লিখিত ও মৌখিকভাবে বক্তব্য পেশ করে আদালতকে সহযোগিতা করেছেন।

এসব বিষয়ে আদালতে অ্যামিকাস কিউরিরা তাদের মতামত তুলে ধরে বলেছেন, দেনমোহরের ক্ষেত্রে এই ধরনের জমি হস্তান্তর- ইসলামী নীতি অনুসারে বৈধ মোহরানা।

বিজ্ঞাপন

অ্যামিকাস কিউরিরা তাদের মতামতে বলেছেন, এটি ঋণ বা দেনা যেকোনো আকারে হতে পারে। এ ছাড়া দেনমোহর পরিশোধ নগদ বা সম্পত্তি বা অন্য কোনো মূল্যবান জিনিসপত্রের আকারেও হতে পারে। এটি স্ত্রীর অধিকার। বিয়ের সময় বা তার পরে স্ত্রীর অনুকূলে মোহরানা প্রদান বা হস্তান্তর করতে স্বামীর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

অ্যামিকাস কিউরিদের মতে, এটা আল্লাহর হুকুম এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নির্দেশ যে, মোহরানা অবশ্যই স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে এবং যতক্ষণ না পরিশোধ করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা স্বামীর ওপর ঋণ বা দায় হিসেবে বজায় থাকবে।

অ্যামিকাস কিউরিরা সর্বসম্মতভাবে আরও বলেছেন, দেনমোহর প্রদানের দায় পিতা, ভাই বা কোনো আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষ থেকে অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারে এবং তা নগদ, মূল্যবান জিনিসপত্র এবং জমি ইত্যাদির আকারেও পরিশোধ করা যেতে পারে।

অ্যামিকাস কিউরিদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেছেন, কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জিনিসপত্র, যা ইসলামে বৈধ, তা দেনমোহরের রূপ নিতে পারে এবং যে কেউ এই দেনমোহর প্রদান বা হস্তান্তর করার দায়িত্ব নিতে পারে।

আদালত আরও বলেছেন, ইসলামিক পণ্ডিতদের উপরোক্ত মতামত থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ভূমি সম্পত্তি, ইসলামের অধীনে একটি বৈধ সম্পত্তি হওয়ায় ইসলামী নীতির অধীনে তা মোহরানা রূপ নিতে পারে এবং স্বামীর পিতাসহ যে কেউ অর্থ প্রদানের দায়িত্ব নিতে পারে।

আলেমদের মতামত অনুসারে, এই ধরনের জমি হস্তান্তর- ইসলামি নীতি অনুসারে বৈধ মোহরানা হিসেবে বিবেচিত হবে।

মামলার বিবরণে জানা যায়, মোহরানার বিপরীতে দেওয়া জমি পেতে সুনামগঞ্জের বিচারিক আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত স্ত্রীর পক্ষে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে হাইকোর্ট স্বামীর আপিল গ্রহণ না করে তা নিষ্পত্তি করে দেন। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে স্বামীর পক্ষে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।

মামলার আইনজীবী ও অ্যামিকাস কিউরিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৫ সালের ১১ জুলাই ৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য করে সুনামগঞ্জের জিয়াউল হকের সঙ্গে ফারহানা ফেরদৌসীর বিয়ে হয়। এর মধ্যে ২ লাখ টাকা অলঙ্কার এবং আসবাবপত্র বাবদ উসুল (মোহরানা পরিশোধ) দেখানো হয়। আর ২ লাখ বাকি রাখা হয় যা স্ত্রীর চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে বলে কাবিননামায় উল্লেখ করা হয়। বাকি ১ লাথ টাকার মোহরানার বিপরীতে স্বামী জিয়াউল হকের পিতা ছদরুল হক পুত্রবধূ ফারহানা ফেরদৌসীকে ০.০৯ একর জমি প্রদান করতে একটি বিবৃতি দেন। যা কাবিননামার ১৬ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়। (কাবিননামার ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে- বিশেষ বিবরণ ও পক্ষগণের মধ্যে চুক্তিসূত্রে নির্ণীত মূল্যসহ কোন সম্পত্তি সম্পূর্ণ দেন মোহর বা উহার অংশ বিশেষের পরিবর্তে প্রদত্ত হইয়াছে কি না? কাবিননামার এই ধারার স্থানে ছদরুল হক বলেন, ‘‘বাবদ নং ১,০০০০০/- (স্টেশন সাব রেজিস্ট্রার দিরাই- সুনামগঞ্জ। আমি ছদরুল হক, আমার খরিদা দলিল নং-৪৭৯২ তাং ১/১২/৮৭ ইং ও দলিল নং ৪৯১৬ তাং ৭/১২/৮৭ ইং মোট পরিমাণ (৫+৪)= ৯ শতাংশ জায়গা, থানা-দিরাই, জেলা- সুনামগঞ্জ, মৌজা -চান্দপুর, জে,এল,নং ৯৯, খতিয়ান নং সাবেক-৩১৫, ডি,পি, খতিয়ান-৬২৮ সাবেক দাগ-১৮৯০ বর্তমান দাগ-৩০৯৮ বাড়ি রকম ভূমি আমার পুত্র বধুকে দিলাম।”

স্বামী জিয়াউল হকের সঙ্গে ফারহানা ফেরদৌসীর দাম্পত্য জীবন চলাকালের এক পর্যায়ে জিয়াউল হক ইংল্যান্ড চলে যায় এবং ২০০৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ফারহানা ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ফারহানা ফেরদৌসী তার শ্বশুরের (জিয়াউল হকের বাবা ছদরুল হক) সঙ্গে যোগাযোগ করলে শ্বশুর তাকে জানায় জিয়াউল হক তাকে কখনো ইংল্যান্ড নিয়ে যাবে না। এরপর ফারহানা ফেরদৌসীর কাবিননামায় উল্লেখিত জমিসহ (জমি ০.০৯ একর) দেনমোহরের অবশিষ্ট অংশ (মোহরানার বিপরীতে বাকি থাকা ২ লাখ টাকা) দাবি করেন। কিন্তু তার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন শ্বশুর। একই সঙ্গে ফারহানাকে বিয়ের সময় ০.০৯ একর জমি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে এবং এ বিষয়ে কোন কিছু প্রতিশ্রতিও দেওয়া হয়নি বলে জানান। এ ছাড়া কাবিননামায় কখনও কিছু লেখেনি বলে তাকে জানানো হয়।

পাশাপাশি ছদরুল হক ফারহানার বিয়ের কাবিননামা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন।

এমতাবস্থায় ফারহানা ০.০৯ একর জমির সাহাম (জমির প্রদত্ত হিস্যা) চেয়ে বিচারিক আদালতে (ভাটোয়ারা) মামলা দায়ের করেন। এরপর বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত মামলার বাদী ফারহানা ফেরদেীসীর পক্ষে রায় দেন।

এরপর বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৬ জুন হাইকোর্টে সিভিল আপিল দায়ের করেন ছদরুল হক। এরপর দীর্ঘ সময় শুনানি শেষে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে আরও কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে আপিলটি নিষ্পত্তি করে দেন। একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের বাদী এবং হাইকোর্টে আপিল মামলার বিবাদী ফারহানাকে একই জমির বিষয়ে এই রায়ের অনুলিপি প্রাপ্তির ৪ (চার) মাসের মধ্যে পারিবারিক আদালতে একটি নতুন মামলা দায়ের করার অনুমতি প্রদান করেন।

তবে জিয়াউল হকের আইনজীবী সুরজিৎ ভট্টাচার্য সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন।

তিনি আরও জানান, মামলা চলাকালেই জিয়াউল হকের সঙ্গে ফারহানা ফেরদৌসের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। বর্তমানে দুজনই আলাদাভাবে লন্ডনে থাকছেন।

সারাবাংলা/কেআইএফ/এএম

টপ নিউজ দেনমোহর মোহরানা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর