ফুটপাত দখলমুক্ত করতে মরিয়া ডিএসসিসি, বড় বাধা ‘পুলিশ’
২৪ মার্চ ২০২২ ১২:১৩
ঢাকা: রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কের ফুটপাত এখন হকারদের দখলে। এমনকি কোথাও কোথাও সড়কের অর্ধেক পর্যন্ত দখল করে ব্যবসা করছে তারা। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত হকাররা এসব দোকান বসিয়ে ব্যবসা করে থাকে। আর ফুটপাতের এসব দোকান থেকে স্থানীয় থানা পুলিশ মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফুটপাত দখলমুক্ত করতে এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন বেশ কয়েকবার গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করেছেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেইসব ফুটপাত ফের দখল হয়ে যায়। একইভাবে ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ফার্মগেট, মিরপুর, মহাখালী, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করে। ধীরে ধীরে সেসব ফুটপাতও দখল করে নিয়েছে হকাররা।
দীর্ঘদিন পর এবার ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস ঢাকা দক্ষিণের ফুটপাত দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ডিএসসিসি বলছে, মেয়র চান, ফুটপাত হোক জনগণের চলাচলের রাস্তা। জনগণ যাতে ভালোভাবে হাঁটতে পারে সেজন্য ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে। কোনো ফুটপাত যেন জনগণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য সবকিছু করা হবে।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২০ মার্চ মতিঝিল শাপলা চত্বর, ফকিরাপুলে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির সামনে, সায়েদাবাদ জনপদ রোড মোড়ে এবং দয়াগঞ্জের জেলে পাড়া এলাকার শহিদ ফারুক রোডের ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন দক্ষিণ সিটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিফা খান।’
তিনি জানান, অভিযানে মতিঝিল শাপলা চত্বর সংলগ্ন সোনালী ব্যাংকের পাশে একটি জরাজীর্ণ যাত্রী ছাউনিসহ এর অভ্যন্তরে অবৈধভাবে স্থাপিত একটি সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্র, ফকিরাপুলে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির সামনে দক্ষিণ সিটির যাত্রী ছাউনি সংলগ্ন ফুটপাতে অবৈধভাবে স্থাপিত লাল–সবুজ পরিবহনের একটি কাউন্টার, সায়েদাবাদ জনপদ রোড মোড়ের ফুটপাত থেকে পাঁচটি স্থায়ী–অস্থায়ী স্থাপনা–দোকান ও একটি অবৈধ পঞ্চায়েত ঘর এবং দয়াগঞ্জের জেলে পাড়া এলাকায় শহিদ ফারুক রোডের উভয় পাশের ফুটপাত থেকে ১৫টি অস্থায়ী স্থাপনা ও দোকান উচ্ছেদ করা হয়। অভিযানকালে সায়েদাবাদ জনপদ রোড মোড়ে ফুটপাত দখল করে পণ্যসামগ্রী রেখে চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি ও রাস্তার ক্ষতি সাধন করায় একটি মামলায় দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযান প্রসঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসিফা খান ওই দিন বলেন, ‘ফুটপাত দখল করে মানুষের চলাচলে বাধাদান এবং রাস্তার শৃঙ্খলা ব্যাহত করায় আজ চারটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে একটি অবৈধ কাউন্টারসহ প্রায় ২২টি স্থায়ী–অস্থায়ী স্থাপনা ও দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে।’
অন্যদিকে জনসংযোগ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গত ২১ মার্চ রাজধানীর শ্যামপুর শিল্পাঞ্চল, ডেমরার ডগাইরের ছোট মুরগীর ফার্ম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে হলসংলগ্ন আনন্দ বাজার এলাকায় অভিযান চালায় ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
অভিযানে নেতৃত্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিফা খান এবং সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান। অভিযানে ৩০টি টিনসেড ও ১০টি আধা–পাকা দোকান উচ্ছেদ করা হয়। এছাড়া উচ্ছেদকৃত মালামাল চার লাখ ২৫ হাজার টাকায় স্পট নিলামে বিক্রি করা হয়।
এছাড়া অভিযানে ডগাইরের ছোট মুরগির ফার্ম এলাকায় ব্যাটারিচালিত অবৈধ তিনটি রিকশা ধ্বংস করা হয়। পরে ডেমরার ডগাইর ও স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ব্যাটারিচালিত অবৈধ এসব রিকশা রাস্তায় না নামাতে ব্যাপকভাবে মাইকিং এবং রিকশাচালকদের সতর্ক করা হয়। অভিযানের পর ফুটপাত ও রাস্তায় মালামাল রাখা হলে তৎসংলগ্ন দোকান সীলগালা করা হবে বলেও মাইকিং করা হয়।
অভিযান প্রসঙ্গে ওই দিন মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘আজকের অভিযানে অবৈধভাবে পরিচালিত রিকশার পাশাপাশি ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে যেসব ব্যক্তি মালামাল রেখেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
এছাড়া ২২ মার্চ দুপুরের পর ফুলবাড়িয়া মার্কেটে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান চালায় ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় অভিযান চলবে। কোথাও বাদ দেওয়া হবে না। এমনকি গুলিস্তানেও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালানো হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আবু নাছের বলেন, ‘একদিকে উচ্ছেদ করা হয়, অন্যদিকে দোকান বসায়। এর পেছনে কারা ইন্ধন দিচ্ছে তা জানা যাচ্ছে না। সবাই সহযোগিতা না করলে ফুটপাত দখলমুক্ত কঠিন হয়ে যাবে। মেয়র মহোদয় ফুটপাত দখলমুক্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।’
কে বা কারা এর পেছনে দায়ী?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটি আমি বলতে পারব না। ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে কমিটি কাজ করছে। কমিটির রিপোর্ট পেলে হয়তো বলা যাবে।’
তবে ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার (২২ মার্চ) সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত উচ্ছেদ করে আসার কিছুক্ষণ পর শোনা যায় যে, ফুটপাত ফের দখল হয়ে গেছে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ফুটপাতের সঙ্গে তারা যুক্ত নন। স্থানীয় থানা পুলিশের সদস্যরা ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করছে। পুলিশই ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় বাধা। পুলিশের কারণেই ফুটপাত উচ্ছেদ অভিযান হয়তো সফল হচ্ছে না।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা যাতে ফুটপাত দখল হওয়ার পেছনে ভূমিকা পালন করতে না পারে সেজন্য পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে মেয়রের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। যেকোনো উপায়ে হোক ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে। অন্যদিকে, কোন এলাকায় কোন নেতা আর পুলিশের কোন সদস্য ফুটপাত দখল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তারও একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করা হলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোন এলাকায় কোন কোন পুলিশ সদস্য ফুটপাত বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তার একটি তালিকা দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব। তবে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে পুলিশের কাছে কোনো সংস্থা অভিযোগ করেনি। নির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম