Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘অদম্য স্বাধীনতা’— একাত্তরের নীরব সাক্ষী

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৬ মার্চ ২০২২ ১৪:০২

ঢাকা: ইঞ্জিনের ডান দিকে গিয়ার, বাঁ দিকে যাত্রীবাহী কোচ। মাঝে থাকা বয়লারের ভেতর দিয়ে উঠে আসা একটি হাত উঁচু করে ধরে রেখেছে লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হয়ে সাতটি ধাপের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই স্মৃতি সৌধের নাম ‘অদম্য স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ আর ফেলে দেওয়া ইট-সুরকি, রড দিয়ে নির্মাণ করা স্মৃতিসৌধটির অবস্থান নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। ক্ষয়ে যাওয়া রেলের যন্ত্রাংশ দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সহর্কমীদের স্মরণে এমনই এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন এখানকার শ্রমিকেরা। এই সহকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরুতেই— একাত্তরের ২৭ মার্চ।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরে সারাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে, ওই সময় দেশের অন্যান্য এলাকার মুক্তিকামী মানুষের মতো নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকেরাও আন্দোলনে যুক্ত হন। সেই আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় সত্তর শতাংশই ছিলেন অবাঙালি। তাদের একাংশ ছিলেন প্রচণ্ড নিষ্ঠুর, বাঙালিবিদ্বেষী। স্বাভাবিকভাবেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং সংখ্যালঘু বাঙালিদের ওপর চালান নির্যাতন।

ওই সময়ে সৈয়দপুরের স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শহিদ ডা. জিকরুল হক, ডা. শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন। তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়ে এক সময় শ্রমিকেরা কারখানায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে যান অবাঙালি শ্রমিকেরা। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে বাঙালি নিধনের এক হিংস্র পরিকল্পনা করেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ। কারখানা গেটের সামনে প্রকাশ্যে কারখানার অ্যাকাউন্ট্যান্ট এম এ আজিজকে নির্মমভাবে হত্যা করে জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর শুরু হয় মুক্তিকামী শ্রমিকদের ওপর অবাঙলিদের অত্যাচার। নিমর্মভাবে হত্যা করে অনেক শ্রমিক-কর্মচারীকে জ্বলন্ত বয়লার ও ফার্নেসের ভেতরে নিক্ষেপ করা হয়। সৈয়দপুর পরিণত হয় অত্যাচার-লুটপাট, হত্যা-ধর্ষণের শহরে। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার খালাসি, ফোরম্যান, পেইন্টার, ফিটার, কামার, টার্নার, ওয়েল্ডার, সুইপার, এলএস, করনিক, সিসি-২, মেক জুনিয়র, হ্যামারম্যান, মেকানিক, খালাসি, মিস্ত্রিসহ বিভিন্ন পদের বহু কর্মচারী শহিদ হন। তাদের চূড়ান্ত তালিকাও তৈরি করা যায়নি। উল্টো সেই ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। শহিদ পরিবারদের হতে হয়েছে নিগৃহীত, সমালোচিত।

স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলে ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেওয়া রেলওয়ে কারখানার সেসব কর্মচারী-শ্রমিকদের জীবন উৎসর্গের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে আনার উদ্যোগ নেন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার তৎকালীন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক, আরএস) হিসেবে কর্মরত মঞ্জুর উল আলম শহিদ পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন কারখানার কর্মকর্তা-শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে। বলেন, শহিদ সহকর্মীদের জন্য নির্মাণ করবেন একটি স্মৃতিসৌধ।

ওই সময়ই একটি স্মৃতিসৌধের জন্য নকশা আহ্বান করা হয়। অনেকেই নকশা তৈরি করেন। এর মধ্য থেকে উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম সাজুর নকশা বাছাই করে কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাশ্রমে স্মৃতিসৌধ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্মৃতিসৌধটির নামও আহ্বান করা হয়। শ্রমিক-কর্মচারীদের পাশাপাশি নাম প্রস্তাব করেন মঞ্জুর উল আলম চৌধুরীর স্ত্রী সামছে আকিদা জাহান। শেষ পর্যন্ত তার দেওয়া নাম ‘অদম্য স্বাধীনতা’কেই চূড়ান্ত হিসেবে বেছে নেন সবাই।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার তৎকালীন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক এবং বর্তমানে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে ইতিহাস বিকৃতির যে প্রক্রিয়া তখন চলছিল, সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম মানুষ যেন ইতিহাস বিকৃত না করতে পারে, যেন সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।

তিনি বলেন, প্রথমে শ্রমিক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করি যে এমন একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা যায় কি না। এরপর ভেবে দেখলাম, তখন কারখানার যে আধুনিয়ান চলছিল, সেখান থেকে ফেলে দেওয়া ইট-সিমেন্ট, রড-প্লেট এগুলোকে কাজে লাগিয়ে সৌধটি নির্মাণ করা যায় কি না। সবার মতামত ও শ্রমিকদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায় ‘অদম্য স্বাধীনতা’।

রেলওয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণে সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ নিইনি। এর পুরোটাই করা হয়েছে শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাশ্রম আর রেলের ফেলে দেওয়া যন্ত্রাংশ ও উপকরণ দিয়ে। আমার এই উদ্যোগ দেখে যদি নতুন প্রজন্ম কিছুটা হলেও সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং উৎসাহ পেয়ে নিজেরা কিছু করতে পারে, তাহলেই এই উদ্যোগ সার্থক হবে।

‘অদম্য স্বাধীনতা’র নকশাকার রেলওয়ের সাবেক উচ্চমান সহকারী মো. রেজাউল ইসলাম সাজু সারাবাংলাকে বলেন, এটি অত্যন্ত আবেগের একটি কাজ। এই সৌধ নির্মাণে যখন নকশা আহ্বান করা হয়, আমিও ভাবতে থাকি কীভাবে এটি তৈরি করা যেতে পারে। নকশার মধ্যে কারখানার কিছু ঐতিহ্য রেখেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশকিছু বিষয় তো রয়েছেই। যারা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতি আর আত্মত্যাগকে ফুটিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর সৈয়দপুর কারখানার আধুনিকায়নে নেওয়া চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কারখানার পরিত্যক্ত ইট, রড, অকেজো লোহার পাত ও রেলের ধাতব সামগ্রী দিয়ে নির্মিত হয় এই স্মৃতিসৌধ।

নকশাকার রেজাউল ইসলাম সাজু বলেন, অনেকটা রেলের আদলে নির্মাণ করা ‘অদম্য স্বাধীনতা’র ওপরে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, তার নিচে রয়েছে হাত যা উৎপাদনের প্রতীক। বাঁ দিকে রয়েছে গিয়ার যা গতি ও শক্তি সঞ্চালনের প্রতীক। এর নিচের ইঞ্জিন গতি ও বাংলাদেশের রেলওয়ের ঐতিহ্যের প্রতীক। একাত্তরে মুক্তিকামী শ্রমিকদের হত্যার পর যে বয়লার ও ফার্নেসে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সেটিই রাখার চেষ্টা করেছি সৌধের মাঝখানের বয়লার ও ফার্নেসে।

স্মৃতিসৌধটির নিচে ডান পাশে রয়েছে ওয়ার্কশপ শেড, যা যান্ত্রিক কারখানার প্রতীক। এর নিচে রয়েছে রেল কোচ, যা বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবার প্রতীক। স্মৃতিসৌধটি দাঁড়িয়ে আছে সাতটি ধাপের সিঁড়ির ওপর। পুরো স্মৃতিসৌধটি একটি উদীয়মান সূর্যের আদলে তৈরি করা হয়েছে, যা স্বাধীনতার নতুন সূর্যের প্রতীক।

২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সব শ্রমিক, কর্মচারী আর কর্মকর্তারা এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এমনকি যারা এই কারখানা পরিদর্শনে আসেন, সবাই ‘অদম্য স্বাধীনতা’র কাছে যান শ্রদ্ধা জানাতে। দায়িত্ব নিয়ে সৈয়দপুরে কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও ‘অদম্য স্বাধীনতা’তে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় কারখানাটি। ১৮৭০ সালে স্থাপিত এই কারখানা দাঁড়িয়ে আছে ১১০ একর জায়গার ওপরে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন ও তার জের ধরে পাকিস্তানিদের গণহত্যার ঘটনায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে কারখানাটি। গণহত্যার সেই ইতিহাস যখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখনই ‘অদম্য স্বাধীনতা’ সেই ইতিহাসকেই তুলে এনেছে মানুষের সামনে। কালের সাক্ষী হয়ে এই স্মৃতিসৌধটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ইতিহাসকেই তুলে ধরতে থাকবে— এমনটিই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

অদম্য স্বাধীনতা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর