Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কালরাতে ফ্যাশন শো, মঞ্চ মাতিয়ে এখন অপু বলছেন ‘বিব্রত’

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৬ মার্চ ২০২২ ২১:৪৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মশাল জ্বালিয়ে, মোমের আলোয়, গান-কবিতায় চট্টগ্রামে যখন একাত্তরের গণহত্যার কালরাতের বিভীষিকা স্মরণ করা হচ্ছিল, তখন বন্দরনগরীর পাঁচতারকা হোটেলে আলো ঝলমল মঞ্চে চলছিল ফ্যাশন শো। এ আয়োজন নিয়ে চট্টগ্রামে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। চিত্রজগতের তারকা, মডেল, ফ্যাশন ডিজাইনার, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী- কে ছিলেন না এই আয়োজনে!

চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস ছিলেন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যমণি। তবে ‘কালরাতে’ ফ্যাশন শো-তে অংশ নিয়ে বিব্রত বলে জানিয়েছেন অপু। তিনি দাবি করেছেন, শিল্পী হিসেবে দায়বদ্ধতার কারণে অনুষ্ঠানটি এড়াতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে দমাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, শুরু করেছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, রমনা কালীমন্দিরসহ বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত জাতীয় গণহত্যা দিবসে শোক আর দ্রোহে চট্টগ্রামে যখন সেই নিধনযজ্ঞের স্মৃতি স্মরণ করা হচ্ছিল চট্টগ্রাম নগরীতে, সেই সময়েই শুক্রবার (২৫ মার্চ) রাতে নগরীর পাঁচতারকা রেডিসন ব্লু বে ভিউ হোটেলের মোহনা হলে চলছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হাল ফ্যাশনের পোশাক প্রদর্শনী এবং বর্ণিল ফ্যাশন শো। ‘লামোর ইভেন্ট প্ল্যানার’ এবং ‘এট্যায়ার ক্লাব বিডি’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এ আয়োজন করে।

আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেই আয়োজনে বক্তব্য দেন বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপের কর্ণধার মঞ্জুরুল হক, হাবিব তাজকিরাজের চেয়ারম্যান সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদ, ফ্যাশন ডিজাইনার আইভি হাসান, আয়োজক লামোর ইভেন্টের সাদ শাহরিয়ার, সাফায়েত সাকি, সাইফ হাসান, এট্যায়ার ক্লাব বিডির আরিফ রহমান ও সবুজ স্বাধীন।

বিজ্ঞাপন

এরপর অনুষ্ঠিত ফ্যাশন শো-তে অংশ নেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের তারকা মডেলরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কিছু সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রচার হয়। অপুকে দেখা যায় হিন্দি গানের সঙ্গে মঞ্চে ক্যাটওয়াক করতে।

এদিকে বিষয়টি জানাজানির পর সমালোচনায় সরব ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই। জ্যেষ্ঠ্য সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্য ‘২৫ মার্চ কালরাত্রিতে চট্টগ্রামে পাঁচ তারকা হোটেলে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্যাশন শো !!’- এই বাক্য ফেসবুকে লিখে শনিবার দুপুর একটার দিকে বিষয়টি নজরের আনেন। এরপর প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানাতে থাকেন অনেকেই।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার ফেসবুকে লেখেন, ‘২৫ মার্চ ভয়াল কালরাতে নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে যে নির্মম, নৃশংস বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল – সেটা একটি স্বাধীনতাকামী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য অপপ্রয়াস। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদ এই ভয়াল কালরাতের দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিশ্ব জনমত তৈরির প্রয়াস চালাচ্ছে। অথচ আমরা অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করছি- এক শ্রেণির মানুষ এই ভয়াল কালরাতের স্মৃতিকে অবজ্ঞা করে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে চলেছে, যা সরকার ও জাতির প্রত্যাশার সাথে চরম সাংঘর্ষিক।’

‘গভীর বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করলাম, চট্টগ্রামে রেডিসনের মতো অভিজাত তারকা হোটেলে ফ্যাশন শো নামে একটি জমকালো অনুষ্ঠান। এগুলো কীসের আলামত ! কারা করছেন এসব আয়োজন? এই ধরনের আয়োজনে আমরা লজ্জিত। এদের জন্য ক্ষোভ-ঘৃণা-ধিক্কার। সরকারের প্রতি দাবি- খতিয়ে দেখুন, এসবের নেপথ্যে আদৌ কী’।

আইনজীবী রাজেশ পাল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২৫ মার্চের কালরাত্রিতে জমজমাট ফ্যাশন প্যারেড চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসনে!!! কি দেখার কথা কি দেখছি ? কি শোনার কথা কি শুনছি? অর্ধশতক পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি। ক্ষমা করুন বীর শহীদেরা। স্বাধীনতার সুফল সবচেয়ে বেশি যারা ভোগ করছে, সেই প্রিভিলেইজড ক্লাসটিই আসলে বুঝে না এর মর্মবেদনা !! আফসোস !!!’

ভয়াল কালরাত স্মরণে শুক্রবার সন্ধ্যায় খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করে। সেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরে ফ্যাশন শো আয়োজন নিয়ে ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এ এস এম জাহিদ হোসেন লিখেন, ‘২৫ মার্চের কালরাত্রিতে নগরীর পাঁচতারকা হোটেলে জমজমাট ফ্যাশন শো আয়োজন করার দুঃসাহসে বাকরুদ্ধ……’

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণামূলক সাময়িকী ‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরা কেউ স্বাধীনতার মর্ম, ইতিহাস, গণহত্যা, রক্ত ও ত্যাগের মূল্য বোঝে না। বোঝার মতো জ্ঞান, উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা তাদের নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্মরণ-সম্মান করা নয়, বরং ক্ষেত্রমতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হিসেবে অভিনেতাদের ব্যবহার করে টাকা কামাইয়ের দৌড়ে এরা বিভোর। গণহত্যা দিবসে এমন শো তারই নমুনা।’

সেই সন্ধ্যায় ফ্যাশন শো-তে অংশ নিয়ে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিকমানের একটি বড় ফ্যাশন শো আয়োজন করায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

তবে একদিনের মাথায় সেই ফ্যাশন শো নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে অপু বিশ্বাস টেলিফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, রাত আটটার মধ্যে প্রোগ্রাম শেষ করতে পারলে আমি অংশ নেব। কিন্তু আয়োজকরা অনুষ্ঠান শুরুই করেছেন রাত সাড়ে নয়টায়। এটা নিয়ে উনাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও হয়। আমি অনুষ্ঠানে অংশ নেব না বলে জানিয়ে দিই। কিন্তু আমি যে হোটেলে উঠেলিাম, অনুষ্ঠানও একই হোটেলে। আয়োজকরা এসে বললেন, দিদি আপনি ছাড়া আর কোনো শিল্পী আমাদের নেই। উনারা অনুরোধ করতে থাকেন। যেহেতু আমাকে নিয়ে কিছু আর্থিক বিষয় উনাদের আছে, একজন শিল্পী হিসেবে আমারও কিছু দায়বদ্ধতা আছে, সেজন্য আমি প্রোগ্রাম করেছি।’

‘ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, আমার কাছে অনেক বড় একটি বিষয়। আমি বাংলাদেশি, বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে। আমি বিব্রত হলেও প্রোগ্রামটা এড়াতে পারিনি। শিল্পী হিসেবে আমার কাজের জায়গা থেকে আমাকে প্রোগ্রামটা করতে হয়েছে। যেহেতু প্রোগ্রামটা ঢাকায় ছিল না, চট্টগ্রামে ছিল। দায়বদ্ধতার কারণে সরে আসতে পারিনি’— বলেন অপু বিশ্বাস।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান লামোর ইভেন্ট প্ল্যানারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদ শাহরিয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পঁচিশে মার্চের কালরাতের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় ছিল। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো উপায় ছিল না। রেডিসন হোটেলের হলরুম রোজার আগে আর খালি পাচ্ছিলাম না। শুধু একদিন শুক্রবার অর্থাৎ ২৫ মার্চই খালি পেয়েছিলাম। আর কোনো বন্ধের দিনে খালি ছিল না। তবে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করেছি গণহত্যা স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। ফেসবুকে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। কিন্তু আমাদের তো প্রোগ্রামটা না করে কোনো উপায় ছিল না।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

অপু বিশ্বাস কালরাত বিব্রত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর