পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি চোখ রাঙাচ্ছে মাছ-মাংসের বাজারে
৩০ মার্চ ২০২২ ১০:৩৬
ঢাকা: পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাজারে। খাদ্যের দাম বাড়ায় মাছ ও মাংসের বাজারও চড়া। প্রথমবারের মতো গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা কেজির রেকর্ড স্পর্শ করেছে। ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মাছের দামও কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশু খাদ্যের দাম বৃদ্ধি মাছ-মাংস ও দুধ-ডিমের বাজারে প্রভাব ফেলছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশু খাদ্যের দাম গত একমাসে ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। আর একবছরে এই বৃদ্ধির হার ৩৫ শতাংশ। বিপরীতে মাংস ও মাছের দাম বেড়েছে ১২ থেকে ১৬ শতাংশ।
ফিড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফআইএবি) তথ্যমতে, ফিড তৈরির বিভিন্ন কাঁচামালের দাম গত একবছরে বেড়েছে গড়ে ৬৩ শতাংশ। সয়াবিন তেল ও পাম ওয়েলের দাম বেড়েছে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত। গত ৭ মাসে সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ ও এক বছরে দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। ফিড তৈরির উপাদান ভূট্টার দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। মূলত এসব উপদানের দাম বাড়ার কারণে বাজারে ফিডের দাম বেড়ে গেছে। আর ফিডের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সরাসরি আমিষের ভোক্তার ওপর। পাতে আমিষ তুলতে এখন ভোক্তাকে বেশ হিসাব করতে হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গরুর মাংস এখন ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও গরুর মাংসের দাম ছিল ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা। মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। আর এক বছর পূর্বে গরুর মাংসের দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। খাসির মাংস এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজিতে। এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজিতে। মাস ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর এক বছর পূর্বে খাসির মাংস বিক্রি হতো ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজিতে।
টিসিবির তথ্যমতে, ব্রয়লার মুরগি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে। আর এক মাস আগে দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। মাস ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি। যেখানে এক বছর আগেও দাম ছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। বাজারে মাছের দামও বেড়েছে। রুই মাছ এখন ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে একই মাছের দাম ছিল ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, গরু পালনের মোট খরচের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ব্যয় হয় ফিডে। গত ৫ থেকে ৬ মাস যাবৎ লাগামহীনভাবে ফিডের দাম বাড়ছে। টিকতে না পেরে ইতোমধ্যে ১০ শতাংশ খামার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাজারো খামার বন্ধ হয়ে গেছে। সামনের দিনে আরও অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। গো-খাদ্যর দাম বাড়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকা। গরুর মাংস কিন্তু এখন আর সবাই কিনতে পারছে না। অথচ এই আমিষ জাতীয় খাবারটি সবার পাতে ওঠা উচিত।
তিনি বলেন, আগে গরু পালতে মাসে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন খরচ হচ্ছে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। আগে যে গরু এক লাখ টাকায় বিক্রি হতো এখন স্বভাবতই তা এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর বাজার ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আর ফিডের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার আশপাশে আগে দুধ ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতো। এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পাবনায় মিল্কভিটা ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় দুধ কিনতো, এখন কিনছে ৪০ থেকে ৪৪ টাকায়। মিল্কভিটা কেজিতে মাত্র ২ টাকা দাম বাড়িয়েছে। গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় দুধের দাম সেভাবে বাড়েনি। ফিডের বাড়তি মূল্যের কারণে খামারিদের টিকে থাকাই দায় হয়ে গেছে।
মহাখালীতে একজন মাংস বিক্রেতার সঙ্গে কথা হলে সারাবাংলাকে তিনি জানান, যে গরু আগে ৫০ হাজার টাকায় কেনা যেত, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৫৫ হাজার থেকে ৫৮ হাজার টাকায়। মূলত গরুর দাম বেশি হওয়ায় মাংসও তাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, পোল্ট্রিতে বেশিরভাগ খরচ হয় ফিডে। ফিডের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর ফিডের উপকরণের দামও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অনেক পোল্ট্রি ও ফিড মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে উপকরণের (ভুট্টা ও সয়াবিন মিল) দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে পুরো খাতটিতে।
তিনি বলেন, খাদ্যের দাম বাড়লে মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়বেই। ডিম তৈরিতে খরচ বেড়েছে দেড় টাকা। ডিমের দাম হওয়া উচিত ৯ টাকা, কিন্তু খামারিরা ৭ টাকায় বিক্রি করছে। খামারিরা কিভাবে টিকে আছে সেটাই বড় প্রশ্ন। যেহেতু খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে তাই মাংস ও ডিমের দামও বেড়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফার্ম না টিকলে দেশের আরও বড় ক্ষতি হবে। মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ করা কষ্টকর হয়ে যাবে। খামারিদের কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সরকারকে এখনই তা চিন্তা করতে হবে। কাওরান বাজারে মরুগির মাংসের বিক্রেতা হারুন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এখন পোল্ট্রি মুরগি ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কেনার পর বিক্রির আগ পর্যন্তও ফিডের খরচ আছে। ফিডের দামও বেড়েছে। মুরগিও কিনতে হচ্ছে বেশি টাকা দিয়ে। তাই মুরগিও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
যা বলছেন উদ্যোক্তারা
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার সোহেল মৎস খামারের মালিক মো. সুজন মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, আগে যে ফিড ৩২ টাকা দিয়ে কেনা হতো এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৭ টাকা কেজিতে। আরেক ধরণের ফিড (বিশ্বাস) যা আগে বিক্রি হতো ৩৫ টাকা কেজিতে, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৭ টাকা কেজিতে। ফিডের দাম বাড়ায় মাছ চাষ ব্যহত হচ্ছে। তিনি বলে, ফিডের দাম যেভাবে বেড়েছে, মাছের দাম সেভাবে বাড়েনি। এখন পাঙ্গাস ১০০ থেকে ১১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আগে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতো। ফিডের দাম কমাতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বোরহান এগ্রোর মালিক বোরহান উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, বাজারে গো-খাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। আগে যে ভূষি ১১০০ টাকা বস্তায় কেনা যেত, এখন তা ১৬০০ টাকা বস্তায় কিনতে হচ্ছে। যে খৈলের বস্তা (৭৪ কেজি) ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। বাজারে এখন ভূট্টার দামও বেড়েছে। আমরা নিজেরই ভূট্টা থেকে গোখাদ্য তৈরি করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, দুধ এখন ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। আগে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতাম। খাদ্যের দাম বাড়লেও সেই তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
এই খামারী আরও বলেন, গরুর মাংস এখন ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আগামী কোরবানি ঈদে গরুর দাম আরও বাড়বে। আমরা আগে যে গরু ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতাম, এবার সেই গরু ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ফলে সামনের কোরবানি ঈদে গরুর দামও বাড়তি থাকবে।
খলিলুর রহমান নামের একজন পোল্ট্রি খামারী সারাবাংলাকে বলেন, এক বছর আগে যে ফিডের দাম (কাজী) ২ হাজার ২৫০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি) ছিল, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৭৫০ টাকা বস্তায়। সিপি নামের যে ফিড ২ হাজার ৩৫০ টাকা বস্তায় কেনা যেত, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৮৫০ টাকা বস্তায়। ফিডের দাম অনেক বেড়েছে। ছোট মরগির দাম বেড়েছে। আগে যে মুরগি ২১ টাকা দিয়ে কেনা যেত, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। আর এখন মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩৩ টাকায়। সেই তুলনায় মুরগির দাম বাড়েনি।
এই খামারি আক্ষেপ করে সারাবাংলাকে বলেন, খুব বেশি একটা লাভ হচ্ছে না। সীমিত লাভ হচ্ছে। ফিডের দাম যেভাবে বেড়েছে মুরগির দাম সেভাবে বাড়েনি। এই ব্যবসায় কোনো স্থিরতা নেই। কখনো ফিডের দাম বাড়ছে, কখনো মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ছে। আবার কখনওবা ব্রয়লার মুরগির দাম একেবারেই কমে যাচ্ছে।
গাজীপুরের ফারুক নামের একজন ব্রয়লার মুরগি চাষি বলেন, খাদ্যের দাম এক মাসে বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। এক দিনের মুরগির বাচ্চা এখন ৫৬ টাকার নিচে নেই। এক কেজি ব্রয়লারের উৎপাদন খরচ ১৪০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে পাইকারি বাজার মূল্য ১৪৫ টাকার বেশি নয়। এই সামান্য লাভে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখা সহজ নয়।
ফিড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফআইএবি)’র তথ্যমতে, বছরে দেশের ফিডের উৎপাদন ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টন। মূলত ফিডের ওপর নির্ভর করে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন। দেশীয় ফিড ইন্ড্রাস্ট্রি থেকেই ফিডের শতভাগ চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। ফিড ইন্ড্রাস্ট্রিতে পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিখাদ্য তৈরিতে প্রধান যে কাঁচামালগুলো ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে- ভূট্টা, সয়াবিন মিল, গম, আটা, ময়দা, ভাঙা চাউল, চাউলের কুড়া, ফিশ মিল, সরিষার খৈল, তৈল, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি অন্যতম। মিট এন্ড বোন মিলের আমদানি বন্ধ থাকায় প্রোটিন উৎস্য হিসেবে সয়াবিন মিল এবং ভূট্টার ওপর নির্ভরশীলতা আগের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেড়েছে।
সংগঠনটির তথ্যমতে, পোল্ট্রি ও পশুখাদ্যে ভূট্টার ব্যবহার প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ এবং সয়াবিন মিলের পরিমান প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। চাহিদার তুলনায় দেশে অর্ধেক ভূট্টা উৎপাদন হয়। আর সয়াবিনের উৎপাদন নিতান্তই নগণ্য। দেশে ‘সয়াবিন মিল’ এর মোট চাহিদা বছরে প্রায় ১৮থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ সয়াবিন মিল বা সয়াকেক দেশীয় সয়াবিন তৈল উৎপাদকারি প্রতিষ্ঠান বা সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রি হতে এবং অবশিষ্ট ২০ থেকে ২৫ ভাগ আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এই সংকট মোকাবিলায় সংগঠনটি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে কর অবকাশ চায়। এরইমধ্যে আসন্ন জাতীয় বাজেটে পোল্ট্রি, মৎস্য ও পশুখাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত সব ধরনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সকল প্রকার আগাম কর (এটি), অগ্রিম আয়কর (এআইটি), উৎস কর (সোর্স ট্যাক্স), মূসক ও শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলও।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এএম