৯০ দিনের কমিটি দিয়ে ৯ বছর, অবশেষে সম্মেলনের তোড়জোড়
৩১ মার্চ ২০২২ ২৩:৩১
চট্টগ্রাম ব্যুরো : ৯০ দিনের আহ্বায়ক কমিটি প্রায় ৯ বছর পার করার পর চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সম্মেলনের আভাস মিলেছে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের আভাস পেয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন যুবলীগ এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একঝাঁক নেতাকর্মী। নগর যুবলীগের নেতারা জানিয়েছেন, মে মাসের শেষদিকে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আভাস তারা কেন্দ্র থেকে পেয়েছেন।
গত ২৬ মার্চ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় সাংগঠনিক কমিটি গঠনের জন্য সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত চেয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। আগামী শনিবার (২ এপ্রিল) থেকে বুধবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় দফতরে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
জানা গেছে, মার্চের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন বাচ্চু এবং চার যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা, ফরিদ মাহমুদ, মাহবুবুল হক সুমন ও দিদারুল আলমকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে বৈঠক করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল। সেই বৈঠকে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সম্মেলনের বিষয়ে নেতারা একমত হন। কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, সম্মেলনের তারিখ তারাই নির্ধারণ করবেন।
জানতে চাইলে যুবলীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য যেভাবে সময় বেঁধে দিয়ে বায়োডাটা চাওয়া হয়েছে, একইভাবে সম্মেলনের সময়ও জানিয়ে দেওয়া হবে। বায়োডাটা নেওয়া শেষ হলেই সম্মেলনের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে।’
নগর যুবলীগের নেতারা জানিয়েছেন, ২২ মে থেকে ২৮ মে’র মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা আশ্বাস পেয়েছেন।
মহিউদ্দীন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মে মাসের শেষ নাগাদ সম্মেলন হতে পারে।’
নগর যুবলীগের এক নেতা বলেন, ‘কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন হয়েছে। চট্টগ্রামে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতার পর ঢাকা থেকে কমিটি ঘোষণা হয়েছে। যুবলীগের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
২০০৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত সভাপতি চন্দন ধর ও সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন নগর যুবলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে ২০১৩ সালের ৯ জুলাই আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১০১ সদস্যের কমিটির মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। এর মধ্যে সম্মেলন করে নিয়মিত কমিটি করার কথা বলা হলেও গত নয় বছরে কমিটি হয়নি। নগরীর ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের মধ্যে কমিটি আছে মাত্র চারটিতে- উত্তর পতেঙ্গা, পতেঙ্গা, পাঠানটুলি ও শুলকবহর। সাংগঠনিক ১৬ থানায় কোনো কমিটি হয়নি।
এ অবস্থায় নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির পাঁচ শীর্ষ নেতার তিনজনই সম্মেলনের মাধ্যমে বিদায় নেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরা হলেন- আহ্বায়ক মহিউদ্দীন বাচ্চু এবং যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা ও ফরিদ মাহমুদ। তিন নেতাই সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যুবলীগ ছেড়ে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাকি দুই যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল হক সুমন ও দিদারুল আলম যুবলীগের রাজনীতিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাহবুবুল হক সুমন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দিদারুল আলম চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এম এ মান্নানের সন্তান। উভয়ই সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন।
মাহবুবুল হক সুমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ কোনো বায়বীয় সংগঠন না। এটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং আমরাই সেটা করেছি। এখন সবাই যুবলীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে চলে গেলে সাংগঠনিক ধারাবাহিকতাটা তো আর রক্ষা হবে না। রাজনৈতিক কমিটমেন্টের একটা বিষয় তো আছে। সেজন্য আমরা ইচ্ছা, আমি যুবলীগটা করব। সভাপতি পদের জন্য আমি জীবনবৃত্তান্ত জমা দেব। আমি যুবলীগের সর্বশেষ কমিটিসহ গত তিন কমিটিতে আছি। আমি বিদায় না নিয়ে সংগঠনটাকে আরও এগিয়ে নিতে চাই।’
এদিকে দীর্ঘসময় পর নগর যুবলীগের নেতৃত্বে পরিবর্তনের আভাস পেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে বর্তমানে সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত থাকা নেতাকর্মী এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের মধ্যে। সংগঠনে পদ-পদবি না থাকার পরও রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা নেতাকর্মীরা যুবলীগের মাধ্যমে নেতৃত্বে আসার স্বপ্ন দেখছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা দু’টি বলয়ে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিনের অবর্তমানে এই বলয়কে ছায়া দিচ্ছেন তার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এ ছাড়া নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে আরেকটি বলয় সক্রিয় আছে। এর বাইরে সাংসদ ও জ্যেষ্ঠ্য নেতাদের অনুসারী হিসেবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ থাকলেও মূল রাজনীতি বিভক্ত নওফেল-নাছির বলয়েই।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়করাসহ বর্তমান কমিটিতে প্রাধান্য আছে মহিউদ্দিনের অনুসারীদের। বিদ্যমান আহবায়ক কমিটি অনেক সদস্যই যুবলীগের নেতৃত্বের সামনের সারিতে আসতে চান।
সভাপতি প্রার্থী নুরুল আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ১৯৮৫ সালে স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হই। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ছাত্রলীগের লিয়াকত শিকদার-নজরুল ইসলাম বাবু কমিটির সদস্য ছিলাম। মহিউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। জেল খেটেছি। আমি বিশ্বাস করি, নগর যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পেলে আমি সংগঠনকে আরও গতিশীল করতে পারব।’
একই পদে আসতে ইচ্ছুক শেখ নাছির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে রাজপথে আছি। আন্দোলন-সংগ্রাম, মিটিং-মিছিল কোথাও মহিউদ্দিন ভাইকে ছেড়ে যাইনি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতে সমানভাবে রাজপথে থেকেছি। আমি বায়োডাটা জমা দেব। আশা করি যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাকে মূল্যায়ন করবেন।’
মহিউদ্দিনের অনুসারী নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিমের নাম আলোচনায় আছে সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে আজিমের একটি শক্ত বলয় আছে।
আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব নগর যুবলীগের বর্তমান আহবায়ক কমিটির সদস্য। তিনিও সভাপতি হতে ইচ্ছুক। বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বায়োডাটা জমা দেব। সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রামে যুবলীগকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা আমার আছে। আমি স্কুলজীবন থেকে ছাত্রলীগ করেছি। খেলাঘর করেছি। বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছি। দুইবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি।’
একই বলয়ের নগর যুবলীগের বর্তমান আহবায়ক কমিটির সদস্য দিদারুল আলম দিদারও সভাপতি পদে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন।
সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক- যে কোনো একটি পদে আসতে ইচ্ছুক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দেবাশীষ পাল দেবু। সব বলয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখে চলা দেবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শুধু মিছিল-সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচি করি, তা নয়। নানা সেবামূলক কাজ আমি নিয়মিত করছি। করোনাকালীন যখন সরকার লকডাউন দিল, তখন কেন্দ্রীয় যুবলীগের নির্দেশে আমি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি চাই মানুষের জন্য কাজ করে যুবলীগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমি বায়োডাটা জমা দেব। সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক যে পদেই আমাকে দায়িত্ব দেবে, আমি কাজ করতে পারব।’
সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সনত বড়ুয়া, আবু নাছের চৌধুরী আজাদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মো. ইলিয়াস জীবন বৃত্তান্ত জমা দেবেন বলে জানা গেছে।
ফজলে রাব্বী সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, ২০০২ সালে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করে এমফিলও করেছি। আমি মনে করি, শুধু মিটিং-মিছিলের রাজনীতি অনেক হয়েছে। মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, গির্জা নিয়ে ঝগড়ার রাজনীতির দিনও শেষ হয়ে গেছে। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়। এখন আমরা যারা শিক্ষিত যুবক আছি, আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। আমি চট্টগ্রামে যুবলীগকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখান থেকে আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার কাছে অংশ নিতে পারব।’
নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘যুবলীগের কেন্দ্রেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এরপর গতানুগতিক ধারার রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে। চট্টগ্রামেও যুবলীগের গতানুগতিক ধারার রাজনীতি পরিবর্তনের সময় এসেছে। যুবলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি শুধু দিবসভিত্তিক, শুধু দলীয় কর্মসূচি ভিত্তিক কেন হবে ? যুবলীগের রাজনীতি হতে হবে যুবকদের দাবিদাওয়া আদায়ের রাজনীত। অগ্রসর চিন্তার প্রশিক্ষিত যুবসমাজ গঠনের রাজনীতি করতে হবে। আমি মনে করি, এই জায়গায় চট্টগ্রামে যুবলীগকে ঢেলে সাজানোর প্রাসঙ্গিকতা আছে। আমি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যখন ছিলাম, অনেকগুলো শিক্ষার্থীবান্ধব, গণমুখী কর্মসূচি চালু করেছিলাম। যদি যোগ্য মনে করে আমাদের দায়িত্ব দেয়, আমি একইভাবে যুবলীগকেও এগিয়ে নিয়ে যাব।’
সনত বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। চট্টগ্রামে এখন যুবলীগ যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে আমারও ভূমিকা আছে। একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমি যুবলীগের জন্য কাজ করতে চাই। আমি সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য বায়োডাটা জমা দেব।’
এ ছাড়া আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলমগীর টিপু, নগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইয়াসির আরাফাতও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য জীবন বৃত্তান্ত জমা দেবেন বলে জানা গেছে।
ইয়াসির আরাফাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি ঘোষণা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক আমার সমবয়সী, একই ব্যাচের। আমি দীর্ঘসময় ছাত্রলীগ করেছি। বিভিন্ন যুব সংগঠন, ক্রীড়াঙ্গনের সাথেও আমার সম্পৃক্ততা আছে। আমি সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য বায়োডাটা জমা দেব। আশা করি কেন্দ্রীয় কমিটি আমাকে মূল্যায়ন করবে।’
সারাবাংলা/আরডি/একে