Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সচেতনতার অভাবে প্রতিকার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা

সারাবাংলা ডেস্ক
৪ এপ্রিল ২০২২ ১১:৫০

শিশু আইন ও শ্রম আইনসহ বিভিন্ন আইনেই শিশুদের বিভিন্ন ধরনের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে শিশুদের জন্য। এমনকি শিশুরা কোনো কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়লে সেক্ষেত্রেও তারা আইনি সুরক্ষা পেতে পারে। কিন্তু শিশুরা তো বটেই, মা-বাবাসহ অভিভাবকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও শিশুদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে যেসব প্রতিকার পাচ্ছে না, তেমনি অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও সবসময় আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আইনি পরামর্শ বিষয় সারাবাংলার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস পাওয়ারড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক‘ অনুষ্ঠানে আইনজীবীরা এসব কথা বলেন। ‘শিশু আইন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি সারাবাংলার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী। বিশেষ আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোটেক ব্যারিস্টার সিফাত মাহমুদ। ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস’ সঞ্চালনা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন।

শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনে শাস্তির বিধান তুলে ধরে আলোচনায় ব্যারিস্টার নওরোজ চৌধুরী বলেন, শিশুরা পারিবারিক বা সামাজিক পরিমণ্ডলে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে এসব নির্যাতনের কথা অনেক সময়ই প্রকাশ পায় না। অথচ শিশু আইনে শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এর সঙ্গে আর্থিক জরিমানা করার বিধানও রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে শিশুরা তো বটেই, মা-বাবাসহ অভিভাবকরাও শিশু অধিকার সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নন। শিশুরা জানেই না, আইনের মাধ্যমে সে কী ধরনের প্রতিকার পেতে পারে। তাই শিশুদের তাদের অধিকার সম্পর্কে পরিচিত করাতে হবে, শিশু অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকদেরও সচেতন করতে হবে। এই সচেতনতা থাকলে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় আইনি প্রতিকার পাওয়া সহজ হবে।

https://youtu.be/1SxNKQYbwvY

বিদ্যালয় বা মাদরাসায় শিশু নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরে আলোচনায় ব্যারিস্টার সিফাত মাহমুদ বলেন, আমরা অনেক সময়ই পত্রপত্রিকায় খবর দেখতে পাই— বিদ্যালয় বা মাদরাসায় শিশুদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অনেকেই কিন্তু এসব ঘটনায় প্রতিকার চাইতেও যান না। তারা বিষয়গুলো চেপে যান। কিন্তু শিশু আইনের ৭০ ধারায় যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। এসব অধিকার সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করতে হবে। শিশুদের ওপর কী ধরনের আচরণ করলে নির্যাতন বলে বিবেচিত হবে, এ বিষয়ে শিশুদের চারপাশের পরিমণ্ডলে যারা থাকেন, তাদের সবাইকেও সচেতন হতে হবে।

বিজ্ঞাপন

শিশু কারা— সে বিষয়টি তুলে ধরে ব্যারিস্টার নওরোজ বলেন, বাংলাদেশে কয়েকটি আইনে শিশুদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোথাও ১৪ বছর, কোথাও ১৬ বছর পর্যন্ত বয়সীদের শিশু বলা হয়েছে। তবে ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৮ বয়সী সবাই শিশু। এই আইনের ৪ নম্বর ধারায় এটিও স্পষ্টভাবে বলা আছে— অন্য কোনো আইনে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এই আইনের ধারা প্রাধান্য পাবে। সে হিসাবে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু।

আইনে শিশুদের কী ধরনের অধিকার দেওয়া হয়েছে— এ বিষয়টি তুলে ধরে এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু সনদে সই করেছে। ওই সনদ অনুযায়ী শিশুরা সব ধরনের অধিকার পেতে পারে। আইন বলছে— অপরাধে জড়িয়ে পড়লে ন্যায় বিচার, অবসর ও বিনোদন, উন্নত জীবনমান, গ্রেফতার ও দণ্ড থেকে বিশেষ সুরক্ষা, চিকিৎসা পরিচর্যা, জন্ম নিবন্ধন ও আইনসম্মত পরিচিতি, দত্তক গ্রহণ ও প্রদান, পারিবারিক সংহতি, প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার, পরিবারবঞ্চিত শিশুদের সঠিক যত্ন-বিকাশ, শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন, শরণার্থী শিশুদের সুরক্ষা, সঠিক লালন-পালন, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, সংখ্যালঘু শিশুদের নিরাপত্তা— এই সব বিষয়কেই শিশু অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সবকিছু পাওয়া শিশুর আইনি অধিকার।

শিশু অধিকার বিষয়ে অন্যান্য আইনের তথ্য তুলে ধরে ব্যারিস্টার সিফাত মাহমুদ বলেন, শিশু আইন ছাড়াও শ্রম আইনের মাধ্যমে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কাজে নিয়োগ দৌয়া যাবে না। আবার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলককরণ আইনের মাধ্যমে শিশুদের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা বাধ্যতামূলক। শিশুদের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন রয়েছে। বাল্য বিয়ে থেকে সুরক্ষা দিতে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন রয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন। এছাড়া ১৯১৯ সালের কিশোর ধূমপান নিরোধ আইনের মাধ্যমে শিশুদের ধূমপান থেকে বিরত রাখার বিধানও রয়েছে। আর শিশুদের ওপর কোনো অপরাধ করা হলে সেক্ষেত্রে তার সুরক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের জন্য শিশু আইন তো রয়েছেই।

প্রতিটি থানাতেই শিশু কর্মকর্তা এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার শিশু অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব পালনের বিধানের কথা তুলে ধরেন ব্যারিস্টার নওরোজ। তিনি বলেন, প্রতিটি থানায় এক জন করে শিশু কর্মকর্তা থাকার কথা রয়েছে আইনে। ওই কর্মকর্তাকে ন্যূনতম উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার হতে হবে। নারী কর্মকর্তাকে শিশু কর্মকর্তা হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সমাজসেবা অধিদফতরের একজন প্রবেশন কর্মকর্তার শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে নিজ উদ্যোগে কাজ করার কথা।

তিনি বলেন, শিশুদের যেকোনো অপরাধে জামিনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া শিশুদের জামিন দেওয়াটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। শিশু অপরাধের শিকার হলে বা নিজে অপরাধে জড়িয়ে গেলে থানার ওই শিশু কর্মকর্তা এবং সমাজসেবা অধিদফতরের প্রবেশন কর্মকর্তার তাকে অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন করার কথা। থানা থেকে আদালত পর্যন্ত পুরো আইনি বিষয়টি সমাজসেবা কর্মকর্তার দেখভাল করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেক থানাতেও যেমন শিশু কর্মকর্তাকে সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না, তেমনি সমাজসেবার প্রবেশন কর্মকর্তাকেও সবখানে পাওয়া যায় না। ফলে থানাতেও শিশুরা অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইনি অধিকারের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

ব্যারিস্টার সিফাত এ প্রসঙ্গে বলেন, আমার জানামতে, ঢাকা জেলার জন্য মাত্র দুই জন প্রবেশন কর্মকর্তা রয়েছেন। ঢাকা শহরের বিপুলসংখ্যক অধিবাসীর জন্য এই সংখ্যা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

শারীরিক নির্যাতনের বাইরে শিশুদের মানসিক নির্যাতনের বিষয়েও সবাইকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন ব্যারিস্টার সিফাত। এ ক্ষেত্রে আইনের বিধান তুলে ধরে তিনি বলেন, শিশুদের ওপর নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা বলতে আমরা অনেকেই কেবল শারীরিক নির্যাতন বুঝে থাকি। কিন্তু মানসিক নির্যাতন, যা শিশুর মনোজগৎ ও মননকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। শিশু আইনের ৭০ ধারাতেই এ বিষয়ে বলা রয়েছে— কোনো ব্যক্তির হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ, ব্যক্গিত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন এবং এ ধরনের আচরণের ফলে যদি শিশুর জন্য দুর্ভোগ তৈরি হয় কিংবা তার স্বাস্থ্য বা শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় কিংবা মানসিক বিকৃতি ঘটে— তাহলে এসব অপরাধ দণ্ডনীয়। ফলে কেবল শারীরিক নয়, শিশুদের মানসিক নির্যাতনের বিষয়েও সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশু নির্যাতন এবং শিশু অধিকার সুরক্ষায় সচেতনতা গড়ে তোলার দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন দুই আইনজীবী। তারা বলেন, শিশু অধিকার বিষয়ে যদি শিশুসহ তাদের মা-বাবা, অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের সবাই সচেতন হয়, তাহলেই কেবল শিশু নির্যাতন কমিয়ে আনা সম্ভব। সবাই সচেতন হলেই কেবল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শিশুরা অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তাদের আইনি সুরক্ষাগুলো যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব।

ব্যারিস্টার নওরোজ বলেন, শিশু আইনের মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, শিশুদের ওপর অপরাধ হলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু কেবল আইন ও শাস্তি দিয়ে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। সমাজ তখনই এগিয়ে যাবে, যখন মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে। শিশু অধিকার ও শিশুর আইনি সুরক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার হচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচার আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করি। শিশু অধিকার ও শিশুর সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

সারাবাংলা/টিআর

শিশু অধিকার শিশু আইন শিশুর আইনি সুরক্ষা

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর