ছাত্রলীগ দোষের কী করেছে আমি বুঝিনি— নওফেল
৪ এপ্রিল ২০২২ ২০:০৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল বের করে সমালোচনায় পড়া চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের পাশে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় রীতিনীতি পরিচালনার বিষয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বদলে রাষ্ট্র এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গত শুক্রবার (১ এপ্রিল) দুপুরে জুমার নামাজের পর নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গন থেকে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করে নগর ছাত্রলীগ। সংগঠনটির নগর কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর এতে নেতৃত্ব দেন। ইমু-জাকারিয়া চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ছাত্রলীগের এই কর্মসূচির খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের পর থেকে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়। প্রগতিশীল ঘরানার লোকজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও আলোচনা-সমালোচনা ফেসবুকে আসতে থাকে। অনেকে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মিছিলের ছবির সঙ্গে নগর ছাত্রলীগের মিছিলের ছবি জুড়ে দিয়ে সমালোচনায় মেতে ওঠেন। আলোচনা-সমালোচনার মুখে নীরব থাকেন নগর ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
তবে রোববার (৩ এপ্রিল) রাতে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন চট্টগ্রামের কোতোয়ালী-বাকলিয়া আসনের সাংসদ ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সেই স্ট্যাটাসে তিনি সমালোচনাকারীদের ‘একহাত’ নেন। একইসঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত ঐতিহ্য ধারণ ও লালনের কথাও তুলে ধরেন।
ফেসবুকের স্ট্যাটাসে নওফেল লিখেছেন, ‘পবিত্র রমজান কে স্বাগত জানিয়ে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ মিছিল করেছে, বহুদিন ধরেই তারা এটি করছে। এই স্বাগত মিছিল নিয়ে দেখলাম কেউ কেউ সমালোচনা করছেন টিভি-সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছাত্রলীগ এটি করে দোষের কী করেছে, আমি বুঝিনি। যারা এটি নিয়ে খুব সমালোচনা করল, তাদের মধ্যে কেউ কুখ্যাত মামুনুল হককে প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন কি না আমি জানি না। কিন্তু এই ছাত্রলীগই গিয়েছিল। কাজের কাজে কারা থাকে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘তাছাড়া দ্বীন-ই-ইসলাম কি শুধুই ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির জন্য? এভাবে পবিত্র ধর্মকে শুধুই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মালিকানায় ছেড়ে দিলে, আজ টিপ পরা নিয়ে আক্রান্ত হওয়া নারী কাল বোরখা পরা নিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ধর্ম শুধুই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, ধর্ম সাধারণ মানুষের আবেগের। সাধারণ মানুষের রাজনীতি করা যে কোনো সংগঠন শুভেচ্ছা দিতেই পারে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মীয় অনুভুতির প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধাশীল থেকে, বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত ঐতিহ্য ধারণ ও লালন করে, ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আদর্শ নাগরিকের কাজ। সেটিই আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।’
নওফেল আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ, ধর্ম বিরোধী নই। যারা ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের তৈরি করা রীতিনীতি আর আচার কৃষ্টি সবার ওপরে চাপিয়ে দেয়, সেই মৌলবাদী শক্তির বিরোধী আমরা। যার যার ব্যক্তিগত রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি অনুসরণ করে নাগরিকরা চলবেন। এই ব্যক্তি স্বাধীনতায় কোনো প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।’
ফেসবুকে দেওয়া উপমন্ত্রী নওফেলের এই বক্তব্য ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ঘরানার নেতাকর্মীদের প্রশংসা অর্জন করলেও দ্বিমত জানিয়েছেন অনেকে। প্রগতিশীল ঘরানার লোকজন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কথা উল্লেখ করে রাজনীতি এবং ধর্মকে আলাদা রাখার প্রসঙ্গ তোলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ম এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো রাজনীতি থেকে শতভাগ আলাদা থাকতে পারে কি না, সেটা বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, ধর্মীয় বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কোনো সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকে নিতে হবে। ধর্মের নির্দেশনা যাতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হবে।’
‘রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের সাথে অবশ্যই ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা ধর্মের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনার ওপর রাষ্ট্র এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। ধর্ম যেন আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, সেটার জন্যই রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। ধরুন, পর্দার বিষয়ে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যদি কাউকে বাধ্য করে, সেক্ষেত্রে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সেখানে রাষ্ট্রকে ভূমিকা পালন করতে হবে।’
রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে ধর্ম বিশেষ গোষ্ঠীর জিম্মায় চলে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ধর্মকে যদি আমরা ছেড়ে দিই, তাহলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে সেটা চলে যাবে। যে গোষ্ঠীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই, যারা ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে দিতে চায় না, নিজ মনগড়া পদ্ধতিতে ধর্মকে যারা পরিচালিত করে, তাদের জিম্মায় চলে যাবে। ধর্মকে বিদায় দেওয়ার সুযোগ নেই। এটা আবেগের বিষয়, বিশ্বাসের বিষয়। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু যাতে তৈরি না হয়, সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও আছে। সেজন্য আমরা বলছি যে, ধর্ম কোনদিকে যাবে সেটা রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। রাষ্ট্র যদি না দেখে, অনেক ব্যাখা তৈরি হবে। ধর্মকে ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’
রমজানকে স্বাগত জানিয়ে কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘রমজান নিয়ে এই কর্মসূচি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ অনেক বছর ধরে করে আসছে। এবারই প্রথম এটা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। অথচ আমরা দুর্গাপূজা-স্বরস্বতী পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা সকল ধর্মীয় কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের ব্যানার নিয়েই অংশগ্রহণ করি। আমরা সকল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি, আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
‘আমাদেরকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে মিলিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। ছাত্রশিবির কি বড়দিনে যায়, দুর্গাপূজায় যায়? আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম ধর্মের জায়গায়-রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়। ছাত্রশিবির কি সেটাতে বিশ্বাস করে? ইসলাম ধর্মের মালিক কি ছাত্রশিবির? তারা কি ইসলামের ঠিকাদারি নিয়েছে? আমরা যদি মাঠ ছেড়ে দিই, ছাত্রশিবিরের মতো জঙ্গিবাদী, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ধর্মকে হাতিয়ার বানানোর সুযোগ পাবে। আমি জানি না, যারা আমাদের সমালোচনা করছেন, তারা এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেছেন কি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা সারাবাংলাকে জানান, ২০১৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়। এরপর থেকেই ছাত্রলীগ প্রথমে কয়েক বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে এবং গত চার বছর ধরে এককভাবে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করে আসছে। নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবিত থাকা পর্যন্ত নগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে মিছিল হয়েছে। তবে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল হলেও মূল আহ্বান থাকতো, খাতুনগঞ্জের গুদামে কেউ যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুদ না করে এবং অযথা পণ্যমূল্য না বাড়ায়।
এবার রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল হলেও আগের মতো দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি জোরালোভাবে প্রচার না হওয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম