উন্নত হবে জরুরি সেবা ব্যবস্থাপনা, হাসপাতাল থেকে ফিরবে না রোগী
৪ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৫০
ঢাকা: আনিস চৌধুরী। গণমাধ্যমকর্মী। থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। সম্প্রতি রাত ১১টার দিকে তার মায়ের মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যা দেখা দেয়। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য অসুস্থ মাকে নিয়ে ছুটে যান রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালে। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় সেখানে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ছুটে যান শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানেও মেলে না চিকিৎসা সেবা। এর পর একাধিক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলেও মেলেনি চিকিৎসা সেবা। সবশেষে ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি বিভাগে পর্যবেক্ষণ শেষে চিকিৎসা শুরু হয় আনিস চৌধুরীর মায়ের।
আনিস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আসার আগে যেসব জায়গায় গিয়েছি সবই বড় হাসপাতাল বলে পরিচিত। কিন্তু সেখানে রোগীর সমস্যা জানারও সুযোগ পেলাম না। এই দীর্ঘ সময়ে যদি রোগীর কোনো সমস্যা হতো তবে তার দায় কে নিতো?’
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের এক চালক মনির হোসেন লিমন। যক্ষ্মারোগের উপসর্গসহ নিজের অসুস্থ স্ত্রী আকলিমা বেগমকে নিয়ে বরিশালের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন বুধবার (৩০ মার্চ) ভোর রাতে। ভোর ৪টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অপেক্ষা করলেও সেখানে মেলেনি কোনো স্থান। সেখান থেকে রেফার করা হয় শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালে।
যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য পরিচিত শ্যামলীর বিশেষায়িত ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মোনালিসা জানান, কোনোভাবেই এই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যাবে না। তাই শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল এবং শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন তিনি।
কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকায় শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পায়নি আকলিমা বেগম।
যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত হওয়ার পরেও কেন ছাড়পত্র দেওয়া হলো সেটা জানতে চাইলে শ্যামলীর বিশেষায়িত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মোনালিসা জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে আকলিমার চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব ছিল না।
তবে পরবর্তীতে বুধবার (৩০ মার্চ) রাতেই আকলিমাকে ভর্তি করা হয় শ্যামলীর বিশেষায়িত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালে। এর পর ডা. মোনালিসা জানান, আকলিমার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) লাগবে।
প্রায় বাধ্য হয়েই অসুস্থ স্ত্রীকে বাঁচাতে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউটসহ রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালে ঘুরেও একটি আইসিইউ বেড যোগাড় করতে পারেনি লিমন। অথচ শ্যামলীর বিশেষায়িত ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালেই ছিল আইসিইউ ব্যবস্থাপনা।
প্রতিষ্ঠানটিতে আইসিইউ থাকার পরেও কেন বাইরে যেতে হবে?- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি ডা. মোনালিসা। হাসপাতালটিতে দায়িত্ব পালন করা একাধিক চিকিৎসকের কাছেও এ বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মনির হোসেন লিমনের তাই প্রশ্ন, এই ঢাকা শহরে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর সামর্থ্য না থাকলে কি গরিবরা চিকিৎসা পাবে না?
সাম্প্রতিক এমন একাধিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নড়ে চড়ে বসেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরও। কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি রাখার পাশাপাশি অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের জরুরি সেবা ব্যবস্থাপনা কীভাবে উন্নত করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
শুধুমাত্র জরুরি সেবা ব্যবস্থাপনা উন্নত করাই নয়, একইসঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার পরে কোনো রোগী যেন চিকিৎসা না পেয়ে ভোগান্তির শিকার না হয় সেজন্যেও কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেইসঙ্গে রোগীদের সবধরনের প্যাথলজিক্যাল নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই করানোর জন্য নিতে যাচ্ছে নতুন পদক্ষেপ।
রোগীদের সেবা প্রদান উন্নতকরণ ও সুবিধা বাড়ানোর জন্য সোমবার (৪ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের এ দিন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবসময় রোগীদের জন্যই কাজ করে যাচ্ছি। কীভাবে রোগীদের সেবার মান বাড়ানো যায় সে বিষয়েও আমরা কিন্তু কাজ করছি। চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে। তারপরেও দেখা যায় নানা সীমাবদ্ধাতার কারণে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় না। সেই জায়গায় আমরা কীভাবে আরও ভালো সেবা দিতে পারি তা নিয়ে আজ আলোচনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকরা আজকে বৈঠকে ছিলেন। সবাই আসলে সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলোর আলোকে বিস্তারিত আলোচনা শেষে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বৈঠকে। সেবার মান উন্নত করতে সেই নির্দেশনাগুলো পূরণে আমরা চেষ্টা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘জরুরি বিভাগে রোগী আসলে যেন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া যায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীদের ঢামেক বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে রেফার করে দেওয়া হয়। এটা কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ল্যাবরেটরি টেস্টগুলো যেন হাসপাতালে সরকারিভাবে করানো যায়- সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
ঢামেক পরিচালক বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে কিছু মোটিভেটেড টিম আছে যারা যেকোনো ক্রাইসিস মোমেন্টে চিকিৎসা সেবা দিতে পারে। যেকোনো জাতীয় প্রয়োজনে যেন আমরা সেবাটা দিতে পারি সেটার জন্য থাকে আলাদা পরিকল্পনা। কিছুদিন আগেই সবাই দেখেছেন ঢাকা কলেজ ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে যারা আহত হয় তাদের আমরা জরুরি ভিত্তিতে সেবা দিই বিশেষ টিমের মাধ্যমে। এই টিমগুলো সেবা ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি জনবল সংকট দেখা দিলে সেখানেও সাপোর্ট দেয়।’
বৈঠকে সর্বোপরি জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা উন্নত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেন হাসপাতাল থেকে রোগীরা ফিরে না যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এক রাতেরই কেউ করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। আজ প্রাথমিকভাবে আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ধীরে ধীরে ইনস্টিটিউটগুলোর পরিচালক ও অন্যান্যদের সঙ্গেও বৈঠকে বসব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত জরুরি সেবা উন্নত করে রোগীদের দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসার আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে যেন কেউ হাসপাতাল থেকে ফিরে না যায়- সে বিষয়েও কাজ করছি। এ জন্য প্রতিটা হাসপাতালে একটা হেল্পলাইন রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও একটি একিউট মেডিসিন কর্নার রাখার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। যাতে অন্তত প্রাথমিকভাবেই দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে যত বেশি সম্ভব ল্যাবরেটরি টেস্টগুলো যেন করা যায় সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এতে করে রোগীদের বাইরে থেকে টেস্ট করানোর জন্য যে কষ্টটা করতে হয় সেটা কমে আসবে বলে আশা করছি। এসব কিছুর পরেও যদি রোগী সেবা না পায় তবে হটলাইন তো থাকছেই অভিযোগ জানানোর জন্য।’
‘সব মিলিয়ে রোগীদের আরও দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসা সেবার আওতায় এনে তার মান বৃদ্ধি করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে আজকের বৈঠকে’— যোগ করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন)।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম