Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বোরো নিয়ে হাওরে শঙ্কা, কাঁচা ধান কাটছে কৃষক

এমদাদুল হক তুহিন, আল হাবিব ও বিজয় দাস
৫ এপ্রিল ২০২২ ২৩:০০

ঢাকা: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরে বাঁধ ভেঙে আক্রান্ত হচ্ছে বোরো ধান। এরই মধ্যে হাওরের তিন জেলা সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওরে বোরো ধান আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এই তিন জেলায় ৬৪৯ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। তবে এই তিন জেলা থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ আরও বেশি। হাওরের নদ-নদীতে পানি বেড়ে যাওয়া, ফসল রক্ষা বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়া এবং কোথাও কোথাও বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কৃষকের এখন মাথায় হাত। স্বপ্নের সোনালি ফসল নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা হাওরের ২ লাখ হেক্টরের বেশি জমি এখন ভাবিয়ে তুলছে দেশের সব মানুষকে।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. বেনজীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, হাওরের কোথাও বাঁধ ভাঙেনি। তবে পানি বেশ ওপরে চলে আসছে। পানি বাঁধের কাছাকাছি। সুনামগঞ্জে গতকাল (সোমবার) থেকে সকাল পর্যন্ত বৃষ্টি খুব একটা বাড়েনি। আগামী দুই দিন পানি বাড়ার কথা না। আমরা প্রত্যাশা করছি কোনো বাঁধ ভাঙবে না।

এক প্রশ্নের উত্তরে বেনজীর আলম জানান, এখন পর্যন্ত হাওরের তিন জেলায় (সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে) ৬৪৯ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণ করা বাঁধগুলো অস্থায়ী। এর পরিবর্তে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা গেলে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা কমে যেত। কিন্তু স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ অনেক ব্যয়সাধ্য।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, হাওরের ৭ জেলায় এবার সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। আরও সাত থেকে আট দিন পর ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা। স্থানীয় জাতের কিছু ধান কাটা শুরু হয়েছে, যেটি আমলে নেওয়ার মতো নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক সারাবাংলাকে বলেন, হাওরবেষ্টিত সাত জেলায় সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর বোরো জমি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৭ সালে ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টর বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে বছরই বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ২ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হলে খাদ্য উৎপাদন শঙ্কায় পড়বে। আমরা আশা করি, তেমন কিছু হবে না। কারণ পানি এখন কমতে শুরু করেছে।

এ বিষয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি এখন উন্নতির দিকে আছে। সেখানে বৃষ্টিপাত নেই, আবার পানিও কমছে। নেত্রকোনায় বৃষ্টিপাত নেই, তবে পানি বাড়ছে। আগামীকাল (বুধবার) থেকে নেত্রকোনায় পানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগামী দুই-তিন বৃষ্টি হওয়ার শঙ্কাও নেই। আশা করা যায়, এর মধ্য সব জায়গায় পানি কমে যাবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উজানেও বৃষ্টি কমে গেছে। আগামী কয়েক দিন সেখানেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার কৃষক কাজল। তার জমি রয়েছে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) বিকেল ৫টার দিকে ডুবাইল হাওরের বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে সুনামগঞ্জের পাঁচটি জেলার ফসল আক্রান্ত হবে। সুনামগঞ্জে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কারণ ডুবাইল হাওরে কয়েক হাজার হেক্টর জমি। অন্তত কয়েক লাখ মণ ধান নষ্ট হবে। আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হব।

নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার আরেক কৃষক শফিকুল সারাবাংলাকে বলেন, নদীতে জোয়ারের পানি এসে গেছে। পানি এখনো বাড়তির দিকে। আমাদের ডিঙ্গিপোতা হাওরের ফসল এখনো আক্রান্ত হয়নি। তবে আমরাও শঙ্কায় আছি।

এদিকে, সুনামগঞ্জ থেকে সারাবাংলার ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট আল হাবিব জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও ধর্মপাশায় বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এখন পর্যন্ত এই জেলাতেই বোরো ধানের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের কাংলার হাওরে পানি ডুকে প্রায় পাঁচশ হেক্টর বোরো ধান ডুবে গেছে। সোমবার রাত পর্যন্ত  সদর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, ছাতক ও শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন হাওরের অন্তত এক হাজার একর বোরো ধান পানিতে ডুবে গেছে।

এদিকে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটাসহ সব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে বোরো ফসলরক্ষা বাঁধে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ। হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় সোমবার রাত থেকেই রাতভর স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ সংস্কারে কাজ করেছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, ফসলরক্ষায় কৃষকসহ সবাইকে সার্বক্ষণিক বাঁধের পাশে থেকে কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে হাওরপাড়ের গ্রামে গ্রামে মাইকিং করা হয়েছে।

সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের গোলাম রব্বানী বলেন, খরচার হাওরে আমি ৫ হাল (২০ একর) বোরো ক্ষেত করেছি। হাওরের বাঁধের কাজ মোটামুটি ভালো হয়েছিল। কিন্তু বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তোলায় এখন হরিমনের বাঁধের নিচ দিয়ে হাওরে পানি ঢুকছে। যদি বাঁধের দূর থেকে মাটি তোলা হতো, এমন বিপদ হতো না।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, এ বছর হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ সঠিকভাবে সঠিক সময়ে শেষ হয়নি। বাঁধে মাটি ফেলার সময়ে কমপ্রেকশন (চাপ দিয়ে মাটি থেকে বাতাস বের করা) করা হয়নি। যার কারণে বাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে।

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিশাল হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ কারও একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। বাঁধের কাজ তদারকি করতে আমার দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি হাওরপাড়ের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে বাঁধের কাজে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানিয়েছি। মানুষদের সচেতন করতে গ্রামে গ্রামে গ্রামে মাইকিং করিয়েছি।

এদিকে, নেত্রকোনা থেকে সারাবাংলার ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বিজয় দাস জানিয়েছেন, হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান হারানোর শঙ্কায় কাঁচা ধান কাটছেন স্থানীয় কৃষকেরা। কারণ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার জেলার খালিয়াজুরীর ধনু নদের পানি বাড়তে শুরু করেছে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত জানিয়েছেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে টানা কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে পানি বাড়ছে।

এম এল সৈকত বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয় প্রদেশের চেরাপুঞ্জিতে ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও সুরমা নদী দিয়ে নেমে খালিয়াজুরী পয়েন্টে ধনু নদীর পানি বেড়েছে ১০ সেন্টিমিটার। সোমবার (৪ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে পরিমাপ করে দেখা গেছে, ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার মাত্র ৫৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে ১৮৩ কিলোমিটার বাঁধের কোনো অংশ এখনও ভাঙেনি। আমরা বাঁশ ও জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধগুলো আরও মজবুত করার চেষ্টা করছি।

স্থানীয় কৃষক সমাজ, উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন মূলত হাওরাঞ্চল। হাওরের একমাত্র ফসল বোরোর ওপরই নির্ভর করেই কৃষকরা সারাবছরের সংসারের খরচ, চিকিৎসা, সন্তানদের পড়ালেখা ও আচার-অনুষ্ঠানের খরচ নির্বাহ করে থাকেন। জেলায় ছোট-বড় মোট ১৩৪টি হাওরের মধ্যে খালিয়াজুরীতেই আছে ৮৯টি হাওর।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, খালিয়াজুরী উপজেলার নিম্নাঞ্চল কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, চুনাই, বাইদ্যারচর, কাটকাইলের কান্দা, টাকটার, মনিজান, লেবরিয়া, হেমনগর, গঙ্গাবদর, নয়াখাল, বাগানী, বৈলং ও ডাকাতখালী হাওরের জমিগুলো তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে বিজয় দাস জানিয়েছেন, অনেক কৃষক পানিতে ডুবে যাওয়া কাঁচা ধানই কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন। এছাড়া হাওর এলাকার নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে হাওরাঞ্চলের বোরো চাষিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তারা ফসল হারানোর ভয়ে কাঁচা ধান কাটছেন।

খালিয়াজুরী সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন জানান, জমিগুলোর ধান পাকতে আরও ১০ দিন দরকার ছিল। তবুও নিরুপায় হয়ে কেটে ফেলতে হচ্ছে। ধান না হোক, অন্তত গরুর খাবারটা সংগ্রহ করা যাবে। তিনি আরও জানান, পানি এভাবে আরও তিন-চার দিন বাড়তে থাকলে সব ফসল তলিয়ে যেতে পারে।

নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এফ এম মোবারক আলী বলেন, হাওরাঞ্চলে কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর দুই সপ্তাহ পর পুরোদমে হাওরে ফসল কাটা শুরু হবে। তবে আগাম বন্যার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আমরা চাষিদের আগাম জাতের ধান লাগানোর পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু অনেকেই অধিক ফলনের আশায় আগাম জাতের ধান কম লাগান।

খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে ধনু নদে পানি বাড়তে শুরু করে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙেনি। নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি আমরা বাঁধের পিআইসি কমিটির সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকদের সতর্ক থাকতে বলেছি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

আগাম বন্যা পাহাড়ি ঢল বোরো তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা বোরো ধান হাওরে বন্যা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর