হ য ব র ল জাপায় অর্থ ও যোগ্য প্রার্থীর সংকট
৭ এপ্রিল ২০২২ ১৪:৫৬
ঢাকা: অর্থসংকট, দলীয় কোন্দল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রতি নেতাকর্মীদের অবিশ্বাস ও অনাস্থা— এসবসহ নানাবিধ সংকটে ভুগছে সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। বর্তমানে দলটির বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো অর্থসংকট। যার কারণে দলের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এরশাদের সময় যারা দলটিকে অর্থ সাহায্য দিতেন তারা এখন দূরে সরে গেছেন। এমনকি দলীয় নেতাকর্মীরাও ঠিক মত চাঁদা দিচ্ছেন না।
এছাড়া দলে রয়েছে পদ নিয়ে নেতায় নেতায় কোন্দল। এই কোন্দল দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেও নেতাকর্মীদের ভেতরের এই কোন্দল দূর করে এক কাতারে আনতে পারেননি। বরং বিতর্কিত ও অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া, তৃণমূলের মতামত ছাড়া বিভিন্ন সময় জেলা-উপজেলা ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিতর্কিত কমিটি গঠন, কমিটিতে যখন তখন পদায়ন, প্রমোশন, বহিষ্কার ইত্যাদি কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং ও আরও কোন্দল বেড়েছে। যার কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য যোগ্যপ্রার্থীর সংকট তৈরি হয়েছে দলটিতে। এমনকি উপনির্বাচন এবং চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও যোগ্যপ্রার্থী দিতে পারেনি তারা। যার কারণে নির্বাচনের ফলাফল খুবই খারাপ হয়েছে। সব মিলিয়ে জাপায় চলছে হ য ব র ল অবস্থা।
এ সব বিষয় নিয়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে কোনো গ্রুপিং নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া জাতীয় পার্টি এখন বেগম রওশন এরশাদ ও গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। বরং তাদের নেতেৃত্বে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জাতীয় পার্টি অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের নেতৃত্বে জনগণের কল্যাণে আমরা আগামীতে যেন ক্ষমতায় যেতে পারি সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আগস্টের পর সারাদেশে জাতীয় পার্টি আরও শক্তিশালী হবে। জেলা ও উপজেলা কমিটিগুলো আগস্টের মধ্যে হচ্ছে। একইসঙ্গে আগামী নির্বাচনের জন্য যোগ্য প্রার্থীও খোঁজা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা ২০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পেয়েছি।’
এদিকে, দলটির জেলা পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই দলটিতে গ্রুপিং বাড়ছে। দলীয় কর্মীরা বিএনপি না আওয়ামী লীগে যোগ দেবে তা নিয়ে ভুগছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। কারণ জাপায় দলীয় প্রার্থীর খুবই অভাব। জাপা ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে অনুষ্ঠিত সবকটি নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা। কিন্তু যোগ্য প্রার্থী না থাকায় খুব খারাপ ফলাফল এসেছে। এমনকি আগামী সংসদ নির্বাচনেও যোগ্য প্রার্থী দিতে পারবে না জাতীয় পার্টি।
২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দক্ষিণ সিটিতে নির্বাচনে অংশ নেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন। কিন্তু তিনি ভোট পান মাত্র ৫ হাজার ৫৯৩। অন্যদিকে উত্তরসিটিতে মনোয়ন বাতিল হয় জাতীয় পার্টিতে নবাগত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের। পরে আর জাপার হয়ে আর কেউ নির্বাচন করতে পারেননি।
একই বছরের ২২ মার্চ মেয়র তাপসের ছেড়ে যাওয়া ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজি মো. শাহজাহান (লাঙ্গল) পান মাত্র ৯৭ ভোট। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন। নির্বাচনে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির মো. নাসির উদ্দিন সরকার লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে পান মাত্র ৩২৫ ভোট।
ওই বছরের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোকছুল আলম (লাঙ্গল) এক হাজার ২৫১ ভোট। একইভাবে যশোর-৬ উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির হাবিবুর রহমান লাঙল প্রতীক নিয়ে এক হাজার ৬৭৮, ঢাকা-৪ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর পান ৪১৩ ভোট। যদিও এদের সবাই নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন।
এ প্রসঙ্গে দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সভা-সমাবেশে ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ‘আমরা গত একবছরে সব নির্বাচনে যেখানে যতটুকু সম্ভব অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করেছি। জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর ২০২০ সাল থেকে দলটিতে চলছে অর্থ সংকট। নেতা-কর্মীদের চাঁদা নির্ধারণ করলেও অনেকেই চাঁদা দেন না। টাকার কারণে সাংগঠনিক কর্মসূচিও চালাতে পারছেন না জিএম কাদের। অর্থাভাবে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনসহ বেশিরভাগ সাংগঠনিক কর্মসূচি সীমিত পরিসরে করতে হয়েছে জাতীয় পার্টিকে।
দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম গোপন রাখার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে জেলা-উপজেলা, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি নেই। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের। কাউন্সিলের পর থেকে এ যাবৎ ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি করতে পারেননি। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় জাপা ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি গঠন করতে পারেনি। ফলে বিকশিত হয়নি দলটির নতুন নেতৃত্ব।’
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০১৭ সালের ৫ মে প্রেসিডিয়াম সদস্য ফয়সল চিশতীকে সভাপতি এবং কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৬১ সদস্যের ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার কমিটি গঠন করে। এটির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। এভাবে দেশের অধিকাংশ জেলা ও উপজেলার কমিটির মেয়াদ নেই।
এছাড়া পার্টির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয় যুব সংহতির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ১৬ আগস্ট। গত বছরের ২৮ জুলাই সাংস্কৃতিক পার্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন নতুন কমিটি হয়নি। সম্প্রতি নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় সৈনিক পার্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় তরুণ পার্টির আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ১১ আগস্ট।
সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে শ্রমিক পার্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে আড়াই বছর আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় আইনজীবী ফেডারেশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৪ সেপ্টেম্বর। জাতীয় মৎস্যজীবী পার্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে চার বছর আগে ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর। সম্মেলনের জন্য সম্প্রতি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে। জাতীয় তাঁতী পার্টির আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পার্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল। এছাড়াও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পার্টি ও পল্লীবন্ধু পরিষদের মেয়াদও শেষ হয়েছে অনেক আগেই।
জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আগামী আগস্টের মধ্যে মূলদল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর জেলা-উপজেলা কমিটি করার ঘোষণা দিলেও তা শেষ করতে পারবেন কি না সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ দলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, শিগগিরই শুধু নতুন কমিটি দিয়ে দলকে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে বলে মনে করছি না। দলকে শক্তিশালী করতে তৃণমূলের কর্মীদের আগে চাঙ্গা করতে হবে। আর সেটা করতে হবে দলীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়েই যোগ্য নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে বলে আশাবাদী তারা।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম