চাঁদা না দিলেই গুলি করত ‘রিয়াজ বাহিনী’
৭ এপ্রিল ২০২২ ১৭:০৮
ঢাকা: হত্যা মামলাসহ ১৫টি মামলার আসামি নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী রিয়াজ বাহিনীর মূলহোতা রিয়াজুল ইসলাম ওরফে শুটার রিয়াজ ও তার ৪ সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। উদ্ধার করা হয় বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন, গুলি, দেশিয় অস্ত্র ও ইয়াবা।
র্যাব জানায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় মামলা পরিচালনার জন্য অর্থ সংকটে ভুগছিল রিয়াজুল ইসলাম ওরফে শুটার রিয়াজ। এই টাকা সংগ্রহের জন্য এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সে। দাবি অনুযায়ী, পুরো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ওই ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে শুটার রিয়াজ বাহিনীর সদস্যরা।
বুধবার (৬ এপ্রিল) রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পেশাদার খুনী ও অবৈধ অস্ত্রধারী শীর্ষ সন্ত্রাসী রিয়াজুল ইসলাম ওরফে শুটার রিয়াজ (২২), ও তার সহযোগী মো. জাহিদুল ইসলাম ওরফে কালা ভাগিনা (২৩), মারুফ হোসেন মুন্না, মো. সেলিম (২৩) ও মো. মাহবুব মিয়াকে (২৩) গ্রেফতার করে।
অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৩টি বিদেশি পিস্তল, ৩টি ম্যাগাজিন, ১২ রাউন্ড গুলি, ৫টি ধারালো দেশিয় অস্ত্র, ১টি মোটরসাইকেল এবং ৬০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘গত ২৯ মার্চ রূপগঞ্জ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য দিবালোকে সশ্রস্ত্র হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধ হয় ও আরও ২০ জন আহত হয়। ওই সময়ে এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। গত ১৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শফিক ও শামীম মল্লিক নামে দুই ব্যক্তিকে তাদের বাসার সামনে অতর্কিতভাবে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে বিদ্যুতের বাড়িতে এসে বিদ্যুৎকে লক্ষ করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলি পাশের বাড়ির একটি মেয়ের চোখে লেগে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই ঘটনায় একটি মামলা হলে মামলার বাদী ও সাক্ষীদেরও হত্যার উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে ও গুলি করে। গত বছরের ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনায় একজন নিহত হয়। এসব ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনাগুলো এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, অবৈধ জমি দখলকে কেন্দ্র করে রিয়াজ বাহিনীর প্রধান শুটার রিয়াজের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়। এ প্রেক্ষিতে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।’
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামিরা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও ও এর আশপাশ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার কাজে উদ্ধারকৃত অবৈধ অস্ত্রসমূহ ব্যবহার করে আসছিল। তাদের সন্ত্রাসী দলের সংখ্যা ১০-১৫ জন। রিয়াজের নেতৃত্বে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য তার বাহিনী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিত। এ ছাড়াও রিয়াজের নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এসব এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত। তারপরও কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে ত্রাস সৃষ্টির জন্য হামলা, আক্রমণ ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। এলাকায় ভয়ে রিয়াজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। রিয়াজের নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী দল এলাকার বালু ভরাট ও মাটি কাটার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ও ট্রাক প্রতি নির্ধারিত হারে তার দল চাঁদা নিয়ে থাকে।’
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রিয়াজুল ইসলাম ওরফে শুটার রিয়াজ সোনারগাঁওয়ের একটি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে ২০১৬ সালে তার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়। রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় চাঁদাবাজি, ভূমি দখল ও ভাড়ায় মারামারি করতে গিয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে অপরাধ জগতের লোকজনের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে মনোমালিন্য হলে সে নিজেই একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে এবং তার সহযোগীদেরকে অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে। সে তার সহযোগীদের নিয়ে সোনারগাঁও এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিত এবং অস্ত্র ঠেকিয়ে বালু ও মাটি ভর্তি ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করত। নারায়ণগঞ্জ এলাকায় অবৈধভাবে জমি দখলের জন্য সে ভাড়ায় তার দল নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করত। তাছাড়াও সে উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে তাদেরকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে সম্পৃক্ত করত। রিয়াজের বড় ভাই মোহাম্মদ আলীও এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত। কিছুদিন আগে রিয়াজ বাহিনীর নেতৃত্বে এসব হামলার পর থেকে সে আত্মগোপনে রয়েছে।
গ্রেফতার রিয়াজের বিরুদ্ধে হত্যা, মারামারি, বিস্ফোরক ও অস্ত্র আইনে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা ও বেশ কয়েকটি জিডি রয়েছে। সে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাবরণ করেছে।
গ্রেফতার জাহিদুল ইসলাম ওরফে কালা ভাগিনা রিয়াজ বাহিনীর প্রধান সহযোগী। সে রূপগঞ্জের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। আগে সে সবজির ব্যবসা করত। ২০১৯ সালে রিয়াজের সঙ্গে পরিচয় হলে রিয়াজ তাকে তার সশস্ত্র বাহিনীতে যুক্ত করে। সে রিয়াজের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। রিয়াজ বাহিনীর অবৈধ অস্ত্র সে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে হেফাজতে রাখত। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মারামারি ও বিস্ফোরক আইনে রুপগঞ্জ থানায় ৬টি মামলা রয়েছে। সে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাবরণ করেছে।
মারুফ হোসেন মুন্না রিয়াজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। সে সোনারগাঁওয়ের একটি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। সে সোনারগাঁও এলাকায় মাটি কাটার ব্যবসা করত। মাটির ব্যবসা করতে গিয়ে ২০২১ সালে সে রিয়াজ বাহিনীতে যোগ দেয়। মাদক সংগ্রহ, সরবরাহ ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে সে রিয়াজকে সহযোগীতা করত। তার নামে রূপগঞ্জ থানায় দুইটি মাদক মামলা রয়েছে। সে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাবরণ করে।
গ্রেফতার মাহবুব মিয়া রূপগঞ্জের একটি কলেজ থেকে ডিগ্রী ৩য় বর্ষ পর্যন্ত পড়ালেখা করে। সে রূপগঞ্জ এলাকায় ইট বালুর ব্যবসা কররে। ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সে রিয়াজ বাহিনীতে যোগ দেয়। সে রিয়াজের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে।
গ্রেফতার সেলিম সোনারগাঁওয়ের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। ২০১৬ সালে সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গিয়ে মসজিদে কার্পেট বিছানোর কাজ করে। কিছুদিন আগে সে দেশে ফিরে এসে রিয়াজ বাহিনীতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হয়।
সারাবাংলা/ইউজে/একে