Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশেই রেল যন্ত্রাংশ তৈরির পরিকল্পনা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:০৯

ঢাকা: একে তো নেই কারো পূর্ব অভিজ্ঞতা। ছিল না মেরামতের কারখানা। ইঞ্জিনে কোনো রকম সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান করা বা প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে আমদানিকারকেরই শরণাপন্ন হতে হবে। এমন জটিল বিষয় মাথায় নিয়েই চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনেছিল সরকার। ৩৫ বছর আয়ুষ্কাল ধরে সরকারকে গছিয়ে দেওয়া সেই ডেমু চালুর বছর দুয়েকের মধ্যেই নষ্ট হতে শুরু করে। যা এখন প্রায় সবগুলোই বিকল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওটি ছিল কয়েকশো কোটি টাকার শ্রাদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

রেলওয়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগোচ্ছেন তারা। ভবিষ্যতে এমন ভুল সিদ্ধান্ত তারা নিতে চান না। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ রেলওয়েকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, সেখানে থাকবে বৈদ্যুতিক, বুলেট ট্রেনের মতো দ্রুত গতির ট্রেনও। এসব ট্রেনের যন্ত্রাংশ আমদানি নির্ভর না হয়ে দেশেই তৈরি করার চিন্তা করা হচ্ছে। এমন পরিকল্পনা থেকে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলের ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিনই পুরনো। যার আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে বহু আগেই। অন্যদিকে ৭৫ ভাগেরও বেশি কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। দীর্ঘদিন ধরে মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে যাত্রী পরিবহন করছে এসব ইঞ্জিন কোচ।

জানা যায়, একটি রেলইঞ্জিনে ২৫ হাজার ধরনের যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। এ সব ইঞ্চিন ও কোচ মেরামতের জন্য প্রয়েজনীয় যন্ত্রাংশের ৯৫ ভাগই আমদানি করতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে এই যন্ত্রাংশ আমদানিকে ঘিরে নানা ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি হয়ে থাকে। ফলে যে পরিমাণ টাকা দরকার হওয়ার কথা তার থেকে বেশি খরচ হয়। এই পরিস্থিতি থেকে বিকল্প পথ খুঁজতে দেশীয় বাজারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

খসড়া নীতিমালায় মোট ১২টি প্রধান বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে দেশে রেলের যন্ত্রাংশ তৈরির প্রেক্ষাপট, আমদানি পরিস্থিতি, কিভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে, কোন ধরনের উদ্যোক্তারা যন্ত্রাংশ তৈরি করবে, কী পদ্ধতিতে তৈরি করবে, নির্মাণ কোম্পানির যোগ্যতা কেমন হবে। পণ্যের কোয়ালিটি কেমন হবে, অনুমোদনের মেয়াদ কত হবে, ক্রয়কারী ও প্রস্তুতকারীর মধ্যে চুক্তি হবে, ব্যর্থ হলে জরিমানা এবং এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।

রেলের যন্ত্রাংশ দেশে তৈরির প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের সবচেয়ে বড় গণযোগাযোগ ব্যবস্থা। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে প্রতিনিয়ত লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) মেরামতের প্রয়োজন হয়। আর মেরামতের জন্য যে যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়, তার অল্পকিছু তৈরি হয় বাংলাদেশে আর ৯৫ ভাগ মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এ জন্য প্রচুর পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো অর্ডার করে সময়মত পণ্য পাওয়াও যায় না, তখন মেরামত কাজ ব্যাহত হয়। এই বিষয়কে সামনে রেখে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও রোলিং স্টকের জন্য যথাসময়ে যথাযথ গুণগতমানের যন্ত্রাংশ পেতে আমদানি নির্ভর যন্ত্রাংশের বিকল্প দেশীয় প্রস্তুতকারক বা উদ্যোক্তা তৈরিতে এ নীতিমালা সহায়ক হবে।

খসড়া নীতিমালাটি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়েছে। যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের আহ্বান করা হবে। যন্ত্রাংস তৈরির জন্য উদ্যোক্তা খুঁজে বের করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।

প্রস্তুতকারীকে বিসিক তালিকাভুক্ত সনদ বা একই রকম সনদসহ অন্য কোনো প্রস্তুতকারীর নিজস্ব কারখানা থাকতে হবে এবং মালিকানার স্বপক্ষে কারখানার লাইসেন্স থাকতে হবে। যন্ত্রাংশ তৈরিতে কারখানার সক্ষমতা থাকতে হবে, অভিজ্ঞ জনবল থাকতে হবে।

এ ছাড়া বছরের মোট উৎপাদনের লক্ষ্য, আয় এসব দেখে যোগ্যতা প্রমাণ করা হবে। উদ্যোক্তাদের করা আবেদন যাচাই বাছাই করে নির্ধারণ করা হবে। কোম্পানি নির্বাচিত হওয়ার পর রেলওয়ে ও নির্মান কোম্পানির মধ্যে চুক্তি হবে।

চুক্তি অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন রেলের ইঞ্জিন- কোচ মেরামতে আমদানি নির্ভর যন্ত্রাংশের বিকল্প উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে এ নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এটি রেলওয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর- উল- আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ট্রেনের ৯৫ ভাগ যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অর্থ খরচ করেও সময়মত যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়না। ফলে নির্ধারিত সময়ে মেরামত করা সম্ভব হয় না।’

ডেমু ট্রেনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে ডেমু ট্রেন যখন কেনা হয় তখন সেগুলোর মেরামতের জন্য কারখানা তৈরি করা হয়নি, যন্ত্রাংশ ভীষণ ব্যয়বহুল। যথাসময়ে মনিটরিং ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ডেমুগুলো বসে গেছে। যা আমরা এখন ঠিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ডেমু মেরামত করতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছি। তারপর ভেবেছি লোকমোটিভ তো আমরাই মেরামত করি, সে ওয়ার্কশপেই আমরা ডেমু মেরামতের কাজ শুরু করি, যা ছিলো অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আশা করছি সেটাতে আমরা সফল হবো।’

তিনি আরও বলেন, রেলের যন্ত্রাংশ যদি দেশে তৈরি করতে পারি তাহলে ওইরকম তিক্ত অভিজ্ঞতার আর মুখোমুখি হতে হবে না। বিদেশি মানের পণ্য যখন দেশে তৈরি করব তখন কোয়ালিটিও সেরকম হতে হবে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর সে জন্যই নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ।

এ নীতিমালায় প্রস্তুতকারী কোম্পানির কী ধরনের সক্ষমতা থাকতে হবে যেমন, মেশিন, মেটিরিয়ালস, জনবল এসব নিশ্চিত করতে হবে। না থাকলে কোথায় এক্সপ্লোর করতে হবে। যন্ত্রাংশ তৈরিতে অনেক বেশি বিনিয়োগ যেহেতু করতে হবে সেখানে যদি আমি পণ্য না নেই তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রথম যে আইটেমে সে সফল হবে সেটির জন্য অন্তত পাঁচ বছরের চুক্তি করা হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য কারখানায় একটি প্রদর্শনী ও সেমিনারের ব্যবস্থা করা হবে, সেখানে নানা যন্ত্রাংশের সঙ্গে উদ্যোক্তারা পরিচিত হবেন এবং ধারণা পাবেন। এরপর নীতিমালাটি রেলমন্ত্রী অনুমোদন করলেই বাস্তবায়ন শুরু হবে।

এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা রেল ব্যবস্থাকে উন্নত করছি। পুরনো ইঞ্জিন বদলে ফেলা হচ্ছে। প্রতি বছরই ইঞ্জিন কোচ যোগ হচ্ছে রেলে। দেশে রেলের যন্ত্রাংশ তৈরি করা গেলে এই খাত পরনির্ভরশীলতা কমবে। অর্থ বাঁচবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত রেলকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা ইঞ্জিন, কোচের যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। সেদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। এখনো আমরা রেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করি। এতে লোকসানও বাড়ে। নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারলে রেলের যন্ত্রাংশ তৈরি করতে দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানানো হবে। এতে করে স্থানীয়ভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং কম দামে যন্ত্রাংশ পাওয়া যাবে।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ২৬৩ টি লোকোমোটিভ রয়েছে। জানা গেছে, এগুলোর মধ্যে ১৭৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ। মেয়াদোত্তীর্ণ এ সব ইঞ্জিনের ৭৮টির বয়সই ৫০ বছরের পুরনো। এমনকি ১৯৫৩ সালে কেনা ৯টি লোকোমোটিভও বর্তমানে চলমান। এগুলোর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ছে আশির দশকে।

সারাবাংলা/জেআর/একে

ইঞ্জিন নীতিমালা বাংলাদেশ রেল রেলওয়ে

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর