ময়লা-আবর্জনা ২৪ ঘণ্টায় পরিণত হবে জৈব সারে!
৮ এপ্রিল ২০২২ ১৪:১৪
ঢাকা: পচনশীল বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরির প্রযুক্তি আনছে এসিআই ফার্টিলাইজার লিমিটেড। এই প্রযুক্তিতে বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন করে বাজারজাত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। ইকোডাইজেস্টার (Ecodigester) নামের এই যন্ত্র বা প্রযুক্তিটি দেশে আনতে আলোচনা চলছে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে। আর প্রযুক্তিটি দেশে আনার পর পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনসহ বেশকিছু সংস্থার সঙ্গে এসিআই আলোচনা চালু রেখেছে।
এসিআই বলছে, ইকোডাইজেস্টার দিয়ে পচনশীল সব ধরনের ময়লা প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ময়লা প্রক্রিয়াজাত করে জৈবসার তৈরিতে সময় লাগে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। ময়লাগুলোকে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পরই তা জৈবসারে রূপান্তরিত হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের এই একটি যন্ত্র দিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ টন জৈব সার তৈরি করা সম্ভব। দেশে এই প্রযুক্তি চালু করা সম্ভব হলে ব্যর্জ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টুল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইকোডাইজেস্টার, যেখান থেকে একইসঙ্গে পাওয়া যায় জমির উর্বরতা বাড়ানোর উপাদান জৈব সার। নেদারল্যান্ডসে এই প্রযুক্তিটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। প্রযুক্তিটি সেখান দেশে আনতে এসিআই সরাসরি কাজ করলেও সার উৎপাদনের মডেলটি কিছুটা ভিন্ন। দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চায় এসিআই। তাদের পরিকল্পনা— সিটি করপোরেশন তাদের ময়লা দিয়ে এসিআইয়ের নিয়ে আসা প্রযুক্তি ব্যবহার করে জৈব সার বানাবে। বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসিআই তা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেবে।
জানতে চাইলে এসিআই ফার্টিলাইজারের বিজনেস ডিরেক্টর বশির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, এই যন্ত্র দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়লা জৈব সারে পরিণত হবে। এর জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে যন্ত্রটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন মার্কেটে বা ক্যাম্পাসেও এটি বসানো যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মেশিনটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ১০ টন ময়লা পরিষ্কারের ধারণক্ষমতার এই যন্ত্র বসাতে তিন থেকে চার কোটি টাকা খরচ হবে।
ময়লা থেকে জৈব সার উৎপাদনে এই যন্ত্রের ব্যবহার কীভাবে হবে— এ বিষয়ে বশির আহমেদ বলেন, আমরা ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ঢাকা সিটি করপোরেশন বলেছে, ময়লা ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের একটি বড় পরিকল্পনা চলছে। তবে রাজশাহী সিটি করপোরেশন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠকও হয়েছে। ধরাবাহিকভাবেই অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গেও কাজ করতে চাই আমরা।
এসিআইয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। সেখানকার প্রতিনিধিরা কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে আসবেন। এরপর আমরা সব অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করব। এরপর আমরা কাজ শুরু করব। এই উদ্যোগে নেদারল্যান্ডস আমাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে বশির আহমেদ বলেন, আমরা এখনো পাইলটিং নিয়ে কিছু চূড়ান্ত করতে পারিনি। তবে এই যন্ত্র বসাতে পারলে ময়লা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আর এই প্রযুক্তিতে প্লাস্টিক জৈব সারে পরিণত হবে না। এক ধরনের স্ক্যানার দিয়ে প্লাস্টিক আলাদা করে ওই ময়লা ইকোডাইজেস্টারে প্রবেশ করাতে হবে।
এসিআই বলছে, প্রাথমিক যে পরিকল্পনা তাতে এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি মডেল। আর বর্জ ব্যবস্থাপনায় কাজ করে সিটি করপোরেশন। এ কারণে এই প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশনকে যুক্ত করতে পারলে সেটি কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলো রাজি থাকলে তাদের ভাগাড়ে এই যন্ত্র দিয়ে সার তৈরি করা হবে এবং নির্দিষ্ট দামে কিনে নিয়ে এসিআই তা বাজারজারত করবে।
এসিআই আরও জানিয়েছে, যন্ত্রটি কিনতে দাম পড়বে দুই থেকে তিন কোটি টাকা। যন্ত্রটি দিয়ে মূলত ময়লার মধ্যে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ছিটানো হবে। সেই ব্যাকটেরিয়া ছিটানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ময়লা পরিণত হবে জৈব সারে। সেই সার কৃষকেরা ফসলের মাঠে ব্যবহার করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই যন্ত্রের মাধ্যমে ময়লা থেকে জৈব সার তৈরি করা হলে সারাদেশে যেসব পচনশীল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে আর কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবস্থাপনা নিয়েও জটিলতা থাকবে না, কমে যাবে ব্যবস্থাপনার খরচও।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার টন জৈব সার ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাজার ১০৫ থেকে ১২০ কোটি টাকার। প্রতি বছর ৩০ শতাংশ করে জৈব সারের বাজার বাড়ছে। জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এসিআই, কাজী, নাজিম, অন্নপূর্ণা উল্লেখযোগ্য। তবে সারাদেশ বিভিন্ন এনজিও’র সহযোগিতায় অনেক কৃষক বাড়িতেই বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম খরচে জৈব সার তৈরি করে থাকেন।
তথ্য আরও বলছে, দেশের শহরাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ এই বর্জের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪৭ হাজার টনে। ১৯৯৫ সালে মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদন হার ছিল শূন্য দশমিক চার ৯ কেজি, যা ২০২৫ সালে দাঁড়াবে শূন্য দশমিক ছয় ৯ কেজিতে। ফলে এসব বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন করা গেলে সেটি জৈব সারের চাহিদা মেটাবে, বর্জ্যের সুব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করবে।
এসিআই বলছে, এই মেশিনের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের পচনশীল বর্জ্য যেমন— খাবার, সবজি থেকে উৎপন্ন ময়লা, মাছ-মাংসের ময়লা, ধান কাটার পর জমিতে পড়ে থাকা খড়, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠাসহ সব বর্জ্যই এই যন্ত্রে কাজ করবে। যেমন— ধান কাটার পর জমিতে যে অবশিষ্ট খড়ের অংশ থাকে, তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া ছিটানো হলেও সেটি পচে গিয়ে সারে রূপন্তরিত হবে।
এসিআই অ্যাগ্রো বিজনেস ডিভিশনের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে এখন যার যেখানে সুবিধা, ময়লা ফেলে। ইকো ডাইজেস্টারে ময়লা ফেললে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সকালেই তা জৈব সারে পরিণত হবে। সেখান থেকেই কৃষকের কাছে সার সরবরাহ করা যাবে। ময়লা যখন অ্যাসেটে (মূল্য/সম্পদ) পরিণত হবে, তখন মানুষ যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলবে না। এই প্রযুক্তি দেশের বর্জ্য ব্যবস্থায় দারুণ পরিবর্তন ঘটাবে। পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি মাটির উর্বরতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই প্রযুক্তি।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
এসিআই এসিআই অ্যাগ্রো জৈব সার বর্জ্য থেকে জৈব সার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা