বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার আশঙ্কা নেই
৯ এপ্রিল ২০২২ ২২:৩২
ঢাকা: দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় দেশ শ্রীলঙ্কা। সম্প্রতি দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় এখন তারা সারাবিশ্বে আলোচনার তুঙ্গে। এদিকে, শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির মতো বিপর্যয়ে বাংলাদেশও পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের দাবি, বাংলাদেশও আগামীতে এ ধরনের সংকটে পড়তে পারে। কিন্তু এখনই সতর্ক হলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি নাও হতে পারে। তবে কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। তাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা নেই।
এদিকে, বাংলাদেশের রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনা মডেল গ্রহণ করায় শ্রীলঙ্কার লাল বাতি জ্বলেছে। তবে জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক।’ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা ও সরকারের সতর্ক অবস্থান— সবকিছু মিলিয়েই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হতে পারে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা।
অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশটিতে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। দৈনিক ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং থাকছে। ফলে বিক্ষোভে নেমেছেন দেশটির সাধারণ জনগণ। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের অনেকে বলছেন, এখানেও আগামীতে এ ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। এজন্য সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। তবে এ ধরনের শঙ্কার কথা নাকচ করে দিয়েছেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন এডিবি’র বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি এডিমন গিনটিং। আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
আইএমএফ ও ইআরডি’র তথ্যমতে, শ্রীলঙ্কার মোট জাতীয় আয় (জিডিপি) ৮২ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের তা ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রেও যোজন যোজন পিছিয়ে শ্রীলঙ্কা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মজুদ ৪৪ বিলিয়ন ডলার, আর শ্রীলঙ্কার মাত্র ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বাংলাদেশকে প্রতি বছর ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ২ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হলো তার জিডিপির ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের তা ১৩ শতাংশ। এছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি, বাংলাদেশের তা ৪৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বৈদেশিক ঋণ কঠিন শর্তে নেওয়া। পক্ষান্তরে সহজ শর্তে এসব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হলো পর্যটন খাত। করোনা মাহামারির কারণে গত দুই বছর এই খাতে ব্যাপক ধস নামে। যার আঘাত লাগে সরাসরি রাজস্ব আয়ে। অপরদিকে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কায় পর্যটক বাড়াতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে ধস এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহও নিচের দিকে নেমে যায়। তার ওপর কর ও ভ্যাট কমায় দেশটির বর্তমান সরকার। এছাড়াও চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাদ দিয়ে অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সেখানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এমনকি এর প্রভাবে দেশটিতে চায়ের উৎপাদনও কমে যায়— এসব কারণে শ্রীলঙ্কায় এই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে বাংলাদেশের নেওয়া বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পগুলো মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যে পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর অন্যতম। এর মধ্যে পদ্মাসেতু ছাড়া বাকি সবগুলো প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোদের বিষয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপি’র ৩৮ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশের (৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা) উৎস বিদেশ। বৈদেশিক ঋণের এই হার জিডিপি’র ১৩ শতাংশ। আইএমএফ’র মতে বৈদেশিক ঋণের হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই তা যেকোনো দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তার কারণ না থাকলেও শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকট দেশেও দেখা দেবে কি না?— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো মিল আছে বলে মনে করি না। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। তার ওপর খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো অর্থ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার কিছু নেই বলে মনে করি।’
তবে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য সব দেশ শিক্ষা নিতে পারে। এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্প বা বিনিয়োগগুলো যেন সুশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো থেকে যে আয় আসবে তার প্রাক্কলন এবং সেগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিনে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে হয়। তাই যেকোনো উন্নয়নশীল দেশকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হার যেন স্থিতিশীল থাকে। আমদানি যেন সময় মতো করা হয়। একইসঙ্গে আমাদের পণ্য ও বাজার বৈচিত্রকরণের দিকে নজর দেওয়া। এক্সচেঞ্জ ব্যয় ম্যানেজমেন্ট করা। কারণ এখন আমদানি ব্যয়ও বাড়বে— এসব জায়গায় নজর দিতে হবে।’
দুই দেশের বৈদেশিক ঋণের তথ্য উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ হলো তার জিডিপির ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের হলো ১৩ শতাংশ। এছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি, আমাদের তা ৪৫ শতাংশ। এছাড়াও বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায়ভার দেশের রফতানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৩ থেকে ৪ ভাগ। সেই অর্থে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আছে। তবে আমরা এখন অনেক প্রকল্প বাস্তায়ন করছি। ৭-৮ বছরে আগেও আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩-৪ বিলিয়ন ডলার, বর্তমানে তা ১২-১৩ ডলারে পৌঁছেছে। তাই এসব কর্মসূচি যেন সময় মতো, সাশ্রয়ী ও দুর্নীতিমুক্তভাবে শেষ হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।’
দেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর যখন ঋণ পরিশোধের সময় আসবে তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিজার্ভের ওপর কোনো চাপ আসবে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে। এরপর এসব প্রকল্প থেকে ঋণ পরিশোধ করা, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় আইইআর (ইনটার্নাল রেট অব রিটার্ন, ইকোনমিক রেড অব রিটার্ন ও ফিন্যান্সিয়াল রেড অব রিটার্ন)- এগুলো যেন আমাদের ঠিক মতো আসে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় অনেক প্রকল্প সময় মতো শেষ করতে পারেনি। অনেক প্রকল্প দীর্ঘতর হয়েছে। ফলে সেগুলোর আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আবার অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলোর দরকার ছিল না। তাই প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে সব প্রকল্পের ঋণ পরিষেবার দায়ভার যেন একসঙ্গে না হয়।’
এদিকে, গত বুধবার (৬ মার্চ) এডিবি’র বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি এডিমন গিনটিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। এছাড়া জিডিপি’র তুলনায় ঋণের অনুপাত সহনীয় মাত্রায় রয়েছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাই শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না বাংলাদেশ।’ দুই দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা কথা উল্লেখ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। যেটা শ্রীলঙ্কার ছিল না। এজন্যই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি।’
এদিকে, ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে একমত পোষণ করে এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটিও অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব থেকে রিটার্ন আসবে। ফলে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে। এতে করে বাড়বে জিডিপিও।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যা দিয়ে আমরা ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তা দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। যা দিকে এক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা চলে না।’
সারাবাংলা/এনএস/পিটিএম