গভীর রাতে সেন্টমার্টিনে নামিয়ে বলা হয় মালয়েশিয়া এসে গেছি
১১ এপ্রিল ২০২২ ১৯:০২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কক্সবাজারের এক যুবলীগ নেতাসহ মানব পাচারের চক্রে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে অন্তত ২০ জনকে ট্রলারে তুলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে বাঁশখালীর এক যুবককে অপহরণের পর হত্যা করে ফের তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়— এ দু’টি ঘটনার সূত্র ধরে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
রোববার (১০ এপ্রিল) রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা সংলগ্ন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার পাঁচজন হলো- বাঁশখালীর ছনুয়ার মো. ইসমাইল (৩২) ও তার ভাই শফিউল আলম (৩৭), একই গ্রামের মোহাম্মদ হোসেন (৬০), বাঁশখালীর পশ্চিম সেলবন গ্রামের মো. ইউনুছ মাঝি (৫৬) এবং পেকুয়ার রাজাখালী গ্রামের রিয়াজ খান রাজু (৪১)।
এদের মধ্যে রিয়াজ খান রাজু নিজেকে পেকুয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। তবে র্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলেও আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের কোনো পদে আছে কি না সেটি তারা নিশ্চিত হতে পারেননি।
সোমবার দুপুরে র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, দুই ভাই ইসমাইল ও শফিউল অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করায়। তাদের টার্গেট বেকার যুবক। বিশেষ করে করোনার সংক্রমণের মধ্যে গত দুই বছরে যারা বেকার হয়েছেন, তারাই মূল টার্গেট।
রিয়াজ খান রাজু পাসপোর্ট বানিয়ে দিত। তার সঙ্গে পাসপোর্টের দালাল ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজোশ রয়েছে। ইউনূছ ট্রলারে করে সাগরপথ পাড়ি দেওয়ার কাজ করত। হোসেন মেম্বার নামে পরিচিত অপরজন টাকা সংগ্রহ, টার্গেট করা লোকজনকে ট্রলারে তুলে দেওয়া— এ ধরনের নানা দায়িত্ব পালন করতো।
‘মালয়েশিয়ায় নেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা দাবি করতো। এর মধ্যে এক লাখ টাকা পাসপোর্ট হস্তান্তরের আগেই নিয়ে নিত। বাকি টাকা ট্রলারে তুলে দেওয়ার পর তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করত’— বলেন র্যাব কর্মকর্তা এম এ ইউসুফ।
মানব পাচারকারী চক্রের এই পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে সোমবার দুপুরে র্যাব কার্যালয়ে হাজির হন কয়েকজন ভুক্তভোগী।
কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে আসা মো. জায়েদ নামে এক ভুক্তভোগী সারাবাংলাকে জানান, তিনি একজন চা-দোকানি। বছরখানেক আগে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে রিয়াজ খান রাজু তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা অগ্রিম নেয়। তাকে পাসপোর্ট করে দিয়ে আরও এক লাখ টাকা নিয়ে নেয়। এর ১৫-২০ দিন পর একদিন গভীর রাতে পেকুয়ার একটি ঘাট থেকে জায়েদসহ অন্তত ২০ জনকে ট্রলারে তুলে নেয়। ২-৩ দিন গভীর সাগরে ঘোরাফেরা করে আরেক গভীর রাতে তাদের এক দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে বলা হয়, এটাই মালয়েশিয়া।
‘যখন সকাল হলো, বুঝতে পারলাম আমাদের মালয়েশিয়ার কথা বলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বাড়ি ফিরে আসি। আমি রাজুর কাছে টাকা ফেরত চাই। এরপর সে আমাকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করে। আমাকে কয়েকবার মারধর করে। মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এর পর একদিন জানতে পারি, আমার বিরুদ্ধে মারামারির অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে। অথচ কোথায় মারামারি হয়েছে, কারা মারামারি করেছে- আমি কিছুই জানি না। রাজু যুবলীগের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে কথা বললেও সমস্যা হয়। এরপর আমি চুপ করে থাকি’— বলেন জায়েদ।
র্যাব কর্মকর্তা এম এ ইউসুফ বলেন, ‘এই চক্রটি মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে অন্তত ১০০ জনের কাছ থেকে টাকা নেয়। এর মধ্যে ৫/৬ জনকে ওইদেশে থাকা প্রবাসী বাঙালিদের মাধ্যমে হোক বা যে কোনো উপায়ে হোক মালয়েশিয়া নিয়ে চাকরি দেয়। বাকিদের মধ্যে কয়েকজনকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে কোনো জঙ্গলে বা দ্বীপে ছেড়ে দেয়। তৃতীয় আরেকটি গ্রুপকে মালয়েশিয়ার বদলে সেন্টমার্টিনে ছেড়ে দেয়। আমরা তাদের কাছ থেকে ৩১টি পাসপোর্ট উদ্ধার করেছি। কিন্তু তাদের প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী এর চেয়ে কয়েকগুণ বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’
বাঁশখালীর চাম্বল গ্রামের জয়নাল আবেদিন নামে আরেক ভুক্তভোগী সারাবাংলাকে জানান, ২০১৩ সালে তার ভাই মোক্তারকে ছনুয়া গ্রামের হোসেন মেম্বারের ছেলে এমরানের মাধ্যমে মোজাম্বিকে পাঠান তারা। ২০১৭ সালে মোক্তার সেখানে অপহরণের শিকার হয়। এর কয়েকমাস পর জয়নালের আরেক ভাই জসিমকেও মোজাম্বিকে নেওয়া হয়। এমরান মোক্তারকে এনে দেওয়ার কথা বলে জসিমের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়। বাঁশখালীতে হোসেন মেম্বার একই আশ্বাস দিয়ে নেয় আরও সাত লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও মোক্তারের সন্ধান মেলেনি।
জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘হোসেন মেম্বারের ছেলে এমরান অনেকদিন ধরে মোজাম্বিকে থাকে। সেখানে তার সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। তারা মুক্তিপণের জন্য আমার ভাইকে অপহরণ করে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা দুই দফায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমার ভাইকে ফেরত দেয়নি। বরং আমার ভাই জসিমকে মোজাম্বিকে নানাভাবে হয়রানি করছিল। কয়েকমাস আগে জসিম দেশে ফিরে আসে।’
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রেফতারের পর হোসেন মেম্বার আমাদের জানিয়েছে, মোক্তারকে মোজাম্বিকে অপহরণের পরপরই খুন করা হয়। কিন্তু সেই তথ্য গোপন রেখে তারা ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে।’
বাঁশখালী-পেকুয়া এলাকা থেকে আরেক গ্রুপকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে ট্রলারে তোলার প্রস্তুতি নিতে রোববার রাতে পাঁচজন পেকুয়ায় রিয়াজ খান রাজুর বাসায় জড়ো হয়েছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম