Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশাখী মেলা-জব্বারের বলিখেলা বন্ধে চট্টগ্রামে বিরূপ প্রতিক্রিয়া

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ এপ্রিল ২০২২ ২১:২২

ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলিখেলা [ফাইল ছবি]

চট্টগ্রাম ব্যুরো: শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা স্থগিতের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বক্তব্য-বিবৃতির পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছেন তারা।

বুধবার (১৩ এপ্রিল) সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলিখেলা ও মেলা স্থগিতের ঘোষণা দেয় জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটি। কারণ হিসেবে বলা হয়, সংস্কার হওয়া চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সেটি উন্মুক্ত করে না দেওয়ায় আয়োজকরা বলিখেলার আয়োজন করতে পারছেন না। এর ফলে বৈশাখী মেলাও স্থগিত করা হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর কুস্তির প্রবর্তন করেছিলেন, যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘বলিখেলা’ নামে পরিচিত।  ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলিখেলার সূচনা করেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলিখেলা। বলিখেলার একদিন আগে-পরে তিন দিন ধরে লালদিঘীর পাড়সহ আশপাশের এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বসে মেলা। এ মেলায় গৃহস্থালি পণ্য থেকে শুরু করে নানা পণ্যের পসরা বসে।

এবার বলিখেলা ও মেলার ১১৩তম আসর হওয়ার কথা ছিল। কোভিড পরিস্থিতিতে গত দুই বছর আয়োজন ছিল না। মাঠ না পাওয়ায় এবারের আসরও হচ্ছে না বলে বুধবার দুপুরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়।

এরপর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘বলিখেলা বাঙালির প্রাণের উৎসব। যুগ যুগ ধরে বলিখেলা উপলক্ষে মেলা চলে এসেছে তার নিজস্ব স্বকীয়তায়। বলিখেলার এ মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতো। চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের জেলার অধিবাসীরাও সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এ মেলার জন্য। এই মেলা ও বলিখেলাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কবি কামরুল হাসান বাদল লিখেছেন, ‘মাঠের অজুহাতে বলিখেলা হবে না, কিন্তু মেলা হবে না কোন অজুহাতে। মেলাকেন্দ্রিক কয়েক লাখ মানুষের পেটে লাথি দিলেন কোন উদ্দেশ্যে?’

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু লিখেছেন, ‘বলিখেলা ও মেলা হতে পারবে না— কারা সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, তাদের নামগুলো প্রকাশ করা দরকার। এটি আমার বাংলার চিরায়িত লোক ঐতিহ্য। আমার সংস্কৃতিচর্চা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বৈশাখ মাসে জব্বারের বলিখেলা ও মেলা হবে, তার অপেক্ষায় থাকি আমারা সারাবছর। আজ বলছে হবে না— এই কথা শুনতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।‘

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ লিখেছেন, ‘এবার ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা বন্ধের সংকেত! চট্টগ্রাম বিদ্বেষীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে! রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই।’

উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা লিখেছেন, ‘জব্বারের বলিখেলা ও মেলা বন্ধ করা উচিত নয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আলীউর রহমান লিখেছেন, ‘লালদিঘী মাঠে ছয় দফা মঞ্চ করতে কয় বছর লাগে? জব্বারের বলিখেলা না হওয়ার জবাবদিহি আপনাদের করতেই হবে।‘

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি অনিন্দ্য টিটো লিখেছেন, ‘দুই বছর মহামারি করোনায় বলিখেলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এই দুই বছরকে ধর্তব্যে নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এবার পরিস্থিতি তো ভিন্ন। তারপরও কেন সম্ভব হচ্ছে না? মাঠ সংকট— যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত! নাকি আমরা পিছু হাঁটছি হাজার বছরের সংস্কৃতি থেকে! বাঙালিয়ানা ঐতিহ্য থেকে! তবে কি এভাবে ঠুনকো নানা অজুহাতে একে একে বন্ধ হয়ে যাবে ইতিহাস বয়ে আনা ঐতিহাসিক সমস্ত আয়োজন!’

ছড়াকার আল রাহমান লিখেছেন, ‘জব্বারের বলিখেলা দিনে না হলে রাতে হোক। লালদীঘির মাঠে না হলে পলোগ্রাউন্ড, আউটার স্টেডিয়াম, ফিরিঙ্গিবাজার নদীর পাড়, বাকলিয়া চরে হোক।’

সাংবাদিক রনি দত্ত লিখেছেন, ‘একটি নগরী অভিভাবকহীন হলে যা হয়, তা-ই হচ্ছে। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে জব্বারের বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা, যা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিও বহন করে। এই খেলা ও মেলা নিছক কোনো মেলা বা খেলা নয়। জব্বারের বলিখেলা এই নগরীর গর্ব ও অহংকার। আমাদের একটি বলি খেলা হয়, একটি মেলা হয়, যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। আপনারা নগরীর হর্তাকর্তারা— এই নগরী ও নগরবাসীকে কখনো মন থেকে ধারণ করে না। এ কারণে হারাতে শুরু করেছে নগরীর স্বকীয়তা। আজ চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকলে ঐতিহ্যের সাথে এই অন্যায় কখনো হতে দিতেন না। যতই শঙ্কা থাকুক, তিনি বলতেন— আমি থাকব, খেলা হবে, মেলা হবে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর আর কোনো রাজনৈতিক নেতা চট্টগ্রামকে মন থেকে ধারণ করেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন ক্ষোভ জানিয়ে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামে খেলা বন্ধ করে গরুর মেলা বসাতে পারলে জব্বারের কুস্তি প্রতিযোগিতা হতে সমস্যা কোথায়? কুস্তিটাও তো খেলা। জব্বারের বলিখেলা। খেলাধুলাতো স্টেডিয়ামেই করে।‘

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর অপু লিখেছেন, ‘১১৩ বছরের প্রাচীন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা বন্ধ করা চলবে না। হাজারও কুটিরশিল্পীর সাথে এতবড় অবিচার মেনে নেওয়া যায় না। এই বলিখেলা ও মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামবাসীর সাথে প্রতারণা। একে রুখে দাঁড়ান।’

জানতে চাইলে জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর লালদিঘীর মাঠে খেলা হয়। চট্টগ্রামবাসীর দাবি মেনে ইতিহাসের আলোকে মাঠ সংস্কার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি উদ্বোধন করবেন। সেজন্য মাঠটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। লালদিঘীর মাঠ ছাড়া অন্য কোথাও এই বলিখেলা আয়োজন সমীচীন হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে মেলা আয়োজনে নেতিবাচক মনোভাব আছে। সব মিলিয়ে আমরা বলিখেলা স্থগিত করেছি। বলিখেলা যেহেতু হতে পারছে না, মেলাও না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে যদি এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন এবং মাঠ খুলে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা বলিখেলা ও মেলা আয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

জব্বারের বলিখেলা টপ নিউজ বিরূপ প্রতিক্রিয়া বৈশাখী মেলা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর