Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পহেলা বৈশাখ: ধর্মান্ধতা রুখে দেওয়ার ডাক চট্টগ্রামে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ এপ্রিল ২০২২ ১৪:৩৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাকে বেগবান করে অন্ধকারের অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার প্রত্যয়ে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করছে চট্টগ্রামের আপামর মানুষ। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে পহেলা বৈশাখে ফের জেগেছে চট্টগ্রামের সিআরবির শিরিসতলা, ডিসি হিল, শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চ। মঙ্গল শোভাযাত্রার ধ্বনি পৌঁছে গেছে নগরের ঘরে ঘরে। প্রাণের সম্মিলনে এক হয়ে মানুষ মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদতা দূরে সরাতে পহেলা বৈশাখের মতো আয়োজনের বিস্তৃতি ঘটানোর তাগিদের কথা জানান দিয়েছে।

কোভিড সংক্রমণ, নিরাপত্তা ইস্যু এবং সর্বোপরি রমজানের কারণে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বর্ষবরণের আয়োজনে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এরপরও নানা শ্রেণিপেশার প্রচুর মানুষ যোগ দিয়েছেন বর্ষবরণের আয়োজনে। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল সিআরবির শিরিসতলা। ডিসি হিলেও সমাগমের কমতি ছিল না। তবে আয়োজকরা মনে করেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সময় বেঁধে দেওয়া, রমজানের কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করাসহ নানা সীমাবদ্ধতা না থাকলে জনসমাগম আরও বেশি হত।

নগরীর সিআরবির শিরিসতলায় এবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চতুর্দশ আয়োজন শুরু হয় বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৮টায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে। নববর্ষ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের উদ্যোগে দিনব্যাপী এই আয়োজনে উদীচী চট্টগ্রাম, সঙ্গীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, সুর সাধনা সঙ্গীতালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে সাংস্কৃতিক ফোরাম, স্বরলিপি সাংস্কৃতিক ফোরাম, সৃজামী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, শব্দনোঙ্গর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসসহ কয়েকটি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দআবৃত্তি পরিবেশন করেন। ওড়িষি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যনীড়, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন।

শিরিসতলার মঞ্চের আয়োজন দেখতে হাজির হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদসহ বিশিষ্টজনেরা। নববর্ষ উদযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মালেককে একুশে পদক পাওয়ায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে দুপুর ১টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

তবে সিএমপির পক্ষ থেকে সিআরবির শিরিসতলার অন্তঃত এক কিলোমিটার দূরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সামনে প্রতিবন্ধক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিআরবিতে প্রবেশের তিনদিকেও গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিরিসতলায় যেতে লোকজনকে গরমের মধ্যে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকদূর। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভোগান্তিও ছিল। বিশেষ করে যেসব শিল্পীরা মঞ্চে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, তাদেরও পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে।

নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সহ সভাপতি ডা. চন্দন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড সংক্রমণের কারণে দুই বছর আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারিনি। একটা ধাক্কা কিছুটা সামলে আমরা এবছর থেকে আবার শুরু করেছি। তবে এখনও কোভিড পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। রমজান চলছে। প্রশাসনের নানা বিধিনিষেধ আছে। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে একটা সংশয় ছিল। এরপরও আমরা সুন্দরভাবে আয়োজন সম্পন্ন করেছি। বাঙালি কখনোই রক্ষণশীলতা-পশ্চাৎপদতার কাছে পরাভব মানেনি। এবারও বর্ষবরণের আয়োজনে চট্টগ্রামে মানুষ প্রমাণ করেছে যে, বাঙালি তার জাতিসত্তার আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

এদিকে নগরীর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় শুরু হয় বর্ষবরণের আয়োজন। ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, গুরুকুল সংগীত একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, গুরুকুল, ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি, নৃত্য নিকেতন, দি স্কুল অব ফোক ডান্স, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, স্বরনন্দন প্রমিত বাংলা চর্চা কেন্দ্র ও বিভাস আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রসহ ৩২টি সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন।

সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুচরিত দাশ খোকন সারাবাংলাকে বলেন, এবার বর্ষবরণের আয়োজন আমাদের অনেক তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে করতে হয়েছে। আদৌ অনুষ্ঠান করতে পারব কি পারব না, এটা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। তবে শেষপর্যন্ত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান হয়েছে। শুরুর দিকে মানুষ কম হলেও ডিসি হিলের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বেলা গড়াতে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। দুই বছর পর এবার আবার আমরা শুরু করেছি। আগামী বছর থেকে আরও গুছিয়ে অনুষ্ঠান করতে পারব।

ডিসি হিলে প্রবেশর আশপাশের সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় সিএমপি। নগরীর ডিসি হিল, চেরাগি পাহাড়, বোস ব্রাদার্সের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে মুক্তমঞ্চের দিকে। পুলিশের কড়াকাড়িতে গরমের মধ্যে ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। নগরীর বাদশা মিয়া সড়কে ক্যাম্পাস থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে নগরীর কাজির দেউড়ি ঘুরে আবার ক্যাম্পাসে যান তারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আক্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক লিটন মিত্র চৌধুরী শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন।

ইলিশ মাছ, মুরগী, টুনটুনি পাখি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি, সিংহ, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ এবং রঙ-বেরঙের সরাচিত্র স্থান পায় শোভাযাত্রায়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পুরো বাদশা মিয়া সড়ক আলপনায় ভরিয়ে তোলা হয়েছে।

চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জহির রায়হান অভি সারাবাংলাকে বলেন, রমজানের কারণে এবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। সেজন্য আমরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে শোভাযাত্রা করেছি।

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকেও বর্ষবরণ উপলক্ষে সকালে শোভাযাত্রা বের হয়। শিল্পকলার অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশু একাডেমি, ফুলকি স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে। নগরীর হাজারী লেইনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর ব্যবস্থাপনায় চলছে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।

বৈশাখের আবাহন শুধু নগরীর ডিসি হিল, সিআরবির শিরিসতলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নগরজুড়ে বিভিন্নস্থানেই বেজেছে বৈশাখের গান। নতুন শাড়ি, নতুন পাঞ্জাবি জড়িয়ে অলি-গলিতে সরব পদচারণা উৎবসপ্রিয় বাঙালির। নানান বয়সী শিশু কিশোর, তরুণ তরুণী বৃদ্ধরাও নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরস্পরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তারা।

আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এই অপশক্তি বাঙালি সংস্কৃতিকে সরাসরি আঘাত করছে। এর মধ্যেও বাঙালি তার শ্রেষ্ঠ প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপন করছে। তবে আমি মনে করি, আমাদের আবহমান যে জাতীয়তাবাদের চেতনা, সেই চেতনাকে আরও শাণিত এবং ধারণ করে অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে হবে। পহেলা বৈশাখ, বসন্তবরণ, বর্ষাবরণের মতো সার্বজনীন আয়োজন আরও ব্যাপকভাবে করতে হবে।

শিরিসতলায় চার বছরের মেয়েকে নিয়ে বর্ষবরণের আয়োজনে শামিল হন বিএসআরএম’র উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ইউসুফ সোহেল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন চেতনার বিরুদ্ধে ধর্মকে উসকে দেওয়া হচ্ছে এবং দুঃখজনকভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও ক্ষেত্রবিশেষে এই উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। আমাদের রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি যারা, তারা একদিকে বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলেন, আবার ধর্মীয় উন্মাদনার উত্থানকেও নীরব প্রশ্রয় দেন, সমাজে বিশেষ ধর্মীয় চেতনার বিস্তারের কথাও তারা বলেন। এর ফলে মৌলবাদিরা বাঙালি সংস্কৃতিকে আঘাত করতে সাহস পাচ্ছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ টিকবে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে যাবে।

নগরীর ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখের উৎসবে আসা কলেজ শিক্ষিকা দিলশাদ বেগম সারাবাংলাকে বলেন, পহেলা বৈশাখ তো শুধু একটি উৎসব নয়। এটি বাঙালির একটি সম্মিলনের আয়োজন। এই উৎসব মানবিকতার কথা বলে। আজ সমাজে মানবিকতার খুবই অভাব। আমরা আজ দেখছি- প্রতিদিন খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। বাঙালির এই সম্মিলিত উৎসব থেকে আমরা এসব অনাচারের প্রতিবাদ এবং মানবিক সমাজ নির্মাণের কথা বলতে চাই।

আবৃত্তিশিল্পী ফারুক তাহের সারাবাংলাকে বলেন, বিভেদের ঊর্ধ্বে ওঠে আমরা সবাই মানুষ। এই মানুষের সংস্কৃতি যেদিন সারা বাংলাদেশে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারব, সেদিনই আমরা সুন্দর স্বদেশ পাব।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) জসীম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা সকাল থেকেই খুবই তৎপর ছিলাম। আমাদের সোয়াট টিম, ডিবিও ছিল। সিআরবির শিরিসতলা, ডিসি হিল, শিল্পকলা, চারুকলা একাডেমি- সব জায়গায় খুবই সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান হয়েছে। কোথাও অপ্রীতিকর কিছু হয়নি।

ছবি: শ্যামল নন্দী

সারাবাংলা/আরডি/এসএসএ

টপ নিউজ পহেলা বৈশাখ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর