Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শব্দ দূষণ প্রভাব ফেলছে শরীর-মনে, পরিবেশ অধিদফতরের ‘নো কমেন্টস’

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৬ এপ্রিল ২০২২ ১৩:০৭

ঢাকা: জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে শব্দ দূষণের শহর ঢাকা। আর চতুর্থ অবস্থানে রাজশাহী। দুইটি শহরেই শব্দের তীব্রতা ১০০ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তীব্র মাত্রার শব্দ দূষণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। এর ফলে দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদির শিকারও হতে পারেন এসব শহরের বাসিন্দারা। তবে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারি কোনো দফতর থেকেই উদ্যোগের কথা জানা যায় না।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএনইপি। তাতে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল এবং রাজশাহীতে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পাওয়া গেছে। বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন বলছে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সবশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত এই মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের তীব্রতা এই নির্ধারিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।

বিজ্ঞাপন

শব্দ দূষণ নিয়ে জানতে চাইলে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, উদ্ভিদ-প্রাণী ও মানুষের জন্য সহনশীল মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ হলে সেটিই শব্দ দূষণ। সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণের সীমার মধ্যে থাকা মাত্রা। রাজধানী ঢাকার আবাসিক এলাকায় পরিবেশ অধিদফতর থেকে দিনে ৫৫ ডেসিবেল ও রাতে ৪৫ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে নীরব এলাকার জন্য দিনের বেলা এই মাত্রা ৫০ ডেসিবেল। নীরব এলাকা বলতে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির, মসজিদসহ সরকারিভাবে গেজেট ঘোষিত কিছু এলাকাও রয়েছে।

ক্যাপসের এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে ড. কামরুজ্জামান জানান, ঢাকার চারটি নীরব এলাকায় মানমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি শব্দ দূষণ ঘটছে। চলমান এই গবেষণাটি অবশ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি বলে জানান তিনি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সবশেষ জরিপে ঢাকা ও রাজশাহীর প্রথম ও চতুর্থ অবস্থান পাওয়া নিয়ে তাই বিস্মিত নন এই পরিবেশবিদ।

মানবশরীরে এ ধরনের তীব্র শব্দ দূষণের প্রভাব তুলে ধরে ড. কামরুজ্জামান বলেন, অতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত তিন ধরনের রোগ দেখা যায়— উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালী সংকোচন ও মায়ো কার্ডিনাল ইনফেকশন। এর ফলে মস্তিষ্কের রোগের মধ্যে আছে মাথা ব্যথা, মস্তিষ্কের গঠনের সমস্যা (বিশেষ করে শিশুদের)। এছাড়াও এরকম শব্দ দূষণের ফলে মানসিক অশান্তি, বদহজম, গ্যাস, রক্তনালী সংকোচন, মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বাঁধা, অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মতো রোগব্যাধি দেখা দেয়।

তীব্র ও ধারাবাহিক শব্দ দূষণ শ্রবণশক্তিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুইভাবেই প্রভাব ফেলে থাকে বলেও জানান অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, এটি শ্রবণশক্তিকে অশান্ত করছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের নানা মাত্রায় শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। এই শ্রবণ বধিরতা আবার নানা মাত্রার। কেউ কেউ বৈদ্যুতি যন্ত্রপাতি যেমন— টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল ইত্যাদির শব্দ শুনতে পেলেও মানুষের কথা কম শুনতে পান। আবার অনেকে মানুষের কথা শুনতে পেলেও গাড়ির হর্ন শুনতে পান না।

উচ্চ মাত্রার শব্দের সঙ্গে হৃদরোগের গভীর সম্পর্ক আছে বলে জানান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মনোজ কুমার সরকার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, অতিরিক্ত শব্দ দূষণের মধ্যে থাকলে মানুষের নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়। উচ্চস্বরের আওয়াজের মধ্যে থাকলে মানুষের রক্তচাপ ওঠানামা করে। হৃদস্পন্দন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণের ফলে উত্তেজনা তৈরি হয়, যা হৃদরোগকে প্রভাবিত করে বলেও জানান ড. মনোজ। তিনি বলেন, এসব ছাড়াও শব্দ দূষণের ফলে মানসিক শান্তি নষ্ট হয়। মানুষের সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম দরকার। কিন্তু সারাক্ষণ উচ্চ মাত্রার শব্দের মধ্যে থাকার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আর ঘুম ঠিকমত না হলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

এদিকে, শব্দ দূষণের ফলে শারীরিক রোগব্যধির বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেকসময় উহ্য থেকে যায়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, উচ্চ মাত্রার শব্দ মানুষের মানসিক অবস্থা বদলে দেয়। দীর্ঘ সময় এর মধ্যে থাকলে মানুষের মেজাজের পরিবর্তন ঘটে, যাকে বলা হয় মুড ডিজঅর্ডার। এর ফলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ে, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। আর বিশেষ শিশুদের শব্দের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। উদ্বেগ, মানসিক চাপ বাড়ার ফলে তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এছাড়াও গর্ভবতী মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে শিশুর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গর্ভের শিশুর ব্যক্তিত্বের গড়ন, আচরণ ও চিন্তায় প্রভাব ফেলতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে শব্দ দূষণের সম্পর্কও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গবেষকরা, যদিও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই। ডা. হেলাল বলেন, শব্দ দূষণের প্রভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে কি না, তা নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় সুনিশ্চিত করে বিষয়টি বলা যায় না। তবে শব্দ দূষণ মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। তাই দুর্ঘটনার পেছনে এর প্রভাব থাকতে পারে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে উচ্চ মাত্রার শব্দের মধ্যে দীর্ঘসময় কাটালে তা উদ্বেগ, মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের চালকদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

এ বিষয়ে ডা. আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, শব্দ দূষণের ফলে নানা মাত্রার শ্রবণবধিরতা দেখা দেয়। সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের চালকরা যেহেতু উচ্চ মাত্রার দূষণের মধ্যে থাকেন, তাই তাদের নানা মাত্রার শ্রবণ বধিরতা থাকার সম্ভাবনা আছে। সড়কে নিয়মিতভাবে চলাচলকারী চালকদের মধ্যেও এমন বধিরতা থাকলে তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

পরিবেশবিদ ও পরিবেশ অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, শব্দ দূষণের এমন তীব্রতা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়ে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সরকারি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ও করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও তার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নো কমেন্ট’। এ বিষয়ে ‘ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’ বলে মোবাইলে জানালেও আর কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

পরিবেশবিদ ও পরিবেশ অধিকারকর্মীরাও বলছেন, সরকারি দফতর থেকে এরকম দিনের পর দিন ‘ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’ জানালেও প্রকৃতপক্ষে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

পরিবেশ অধিদফতর শব্দ দূষণ

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর