দাবি-না দাবির বেড়াজালে ৩ লাশের ঠিকানা এখন মর্গ
১৬ এপ্রিল ২০২২ ২২:০৯
ঢাকা: খোকন নন্দী, ওরফে খোকন চৌধুরী ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৮০ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। এর পর থেকে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ ছিল না তার। ধর্মান্তরিত হওয়ার চার বছর পর ১৯৮৪ সালে মুসলিম এক নারীকে তিনি। এর পর থেকে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়েই দিন পার করছিলেন।
কিন্তু বিপত্তি বাধে ২০১৪ সালের জুনে। ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান খোকন। তার মৃত্যুর পর বাধে আসল বিপত্তি। দুই ধর্মের দুই স্ত্রী খোকনের লাশ দাবি করে বসেন। বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। তবে মীমাংসা না হওয়ায় দীর্ঘ আট বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়ে আছে খোকনের মরদেহ।
জানা যায়, মরদেহটি প্রথমে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে ছিল। সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আদালতের নির্দেশে মরদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। খোকনের প্রথম স্ত্রীর নাম মীরা নন্দী। খোকন মুসলমান হয়ে বিয়ে করেন হাবিবা আকতার খানম নামের আরেক নারীকে। তার মৃত্যুর পর দুই স্ত্রী নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী স্বামীর লাশ সৎকার করতে চান।
এদিকে, ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর আদালত ঢাকা মেডিকেল কলেজের মরচুয়ারিতে খোকনের মরদেহ সংরক্ষণের আদেশ দেন। এরপর ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ মরদেহটি গ্রহণ করেন।
খোকনের দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতারের আত্মীয় মো. সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাবিবা আক্তারের স্বামী মুসলমান। আমরা চাই খোকনের মৃতদেহটি দাফন করতে। মুসলমান হিসেবে মারা গেলে দ্রুত লাশ দাফন করার নিয়ম। খোকন চৌধুরীর মরদেহ আট বছর মর্গে পড়ে আছে। আমরা চাই দ্রুত মৃতদেহটি দাফন করতে। কিন্তু আগের ঘরের স্ত্রী তা মানতে নারাজ।’
জানা গেছে, খোকন চৌধুরী ১৯৮০সালে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে মুসলমান হন। তিনি ১৯৮৪ সালে হাবিবা আকতারকে বিয়ে করেন। হাবিবা আকতার নিঃসন্তান। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন তার স্বামীর আগের স্ত্রী-সন্তান আছে।
হাবিবার আত্মীয় সাগরের দাবি, এত বছর আগের সেই স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে খোকনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারা কখনোই তার খোঁজ নেননি। কিন্তু মারা যাওয়ার পর মৃতদেহের দাবি করছে। স্বামীর সম্পত্তি বিশেষ করে একটি মার্কেটের মালিকানা পাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করছে তারা। এখন আদালত যা আদেশ দেবেন, তাই মেনে নেবেন তারা।
সাগর অভিযোগ করে বলেন, ‘খোকন চৌধুরীর মালিকানাধীন ফার্মগেটে একটি মার্কেট রয়েছে। ওই মার্কেটের ভাড়া তোলা ও সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেই আগের স্ত্রী মীরা নন্দীরা দিনের পর দিন সময় ক্ষেপণ করে মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ফেলে রেখেছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে একটি মৃতদেহ মর্গে পড়ে আছে, অথচ কোনো সুরাহা হচ্ছে না।’
এদিকে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দেবীপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে হাসানুজ্জামান কাজের সন্ধানে বেশ কয়েক বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে থিইসিয়ার (২৬) সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রণয়, এর পর পরিণয়। থিইসিয়া বিয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম রাখেন তিশা জামান। এর পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দেবীপুর গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন তিশা জামান।
তবে একমাত্র ছেলের বউ ভিনদেশি বলে মেনে নিতে পারছিলেন না হাসানুজ্জামানের বাবা-মা। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই সংসারে ঝগড়া-ঝাঁটি শুরু হয়। স্বামীকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিশা ফিরে যেতে চান। কিন্তু হাসানুজ্জামান আর দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে রাজি হননি। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিশা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এরপর থেকে তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। মর্গ থেকে জানা যায়, মৃতদেহটি রাখার পর কেউ কোনো খোঁজ নিতে আসেননি।
হাসানুজ্জামানের পরিবারের দাবি ছিল, তিশা কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেছেন। তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে চৌদ্দগ্রাম থানায় মামলা এবং হাসানুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিনে নিয়ে বেরিয়ে যান।
এদিকে, মার্কিন নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কেট একটি এনজিওর প্রতিনিধি হয়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে আসেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতেন তিনি। একদিন অসুস্থ এক শিশুকে চিকিৎসা দিতে উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে যান। তখন হাসপাতালে কর্মরত ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা মাজেদা বেগমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পর ২০০৭ সালে বিয়ে করেন তারা। এক পর্যায়ে মাজেদা বেগম চাকরি ছেড়ে সংসারে মন দেন।
স্বামী বার্কেটকে নিয়ে দক্ষিণখানের চালাবন মাটির মসজিদ এলাকার একটি বাড়িতে থাকতেন মাজেদা। তার আগের সংসারের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তার সঙ্গে থাকেন। আমেরিকায় রবার্ট বার্কেটের প্রথম পরিবার থাকলেও সেখানে তিনি আর ফিরে যাননি। ২০১৮ সালের ২৫ মে বার্কেট স্ট্রোক করলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরের দিন তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। এর পর থেকে আমেরিকান নাগরিক বার্কেটের মৃতদেহ ঢামেক মর্গে পড়ে আছে।
ওই সময় মাজেদা বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর রবার্ট দু’বার আমেরিকা যান। তবে মাঝে মাঝে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। আমেরিকায় তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। তার মৃত্যুর সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পরিবারের লোকজনকে জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। তারা মোবাইল ফোন নম্বর ও অন্যান্য ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে রবার্টের মূল পাসপোর্ট জমা দিয়েছি। মৃতদেহ সৎকারের ব্যাপারে দূতাবাস থেকে কোনো উত্তর পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘একটা মানুষের মৃতদেহ এতদিন ধরে হিমঘরে পড়ে আছে। আমি আমার স্বামীর শেষকৃত্য করতে চাই।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সহকারী সেকান্দার আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই বিদেশিসহ মোট তিনটি মরদেহ ফ্রিজে আছে। এর মধ্যে একটি মরদেহ দীর্ঘ আট বছর ধরে রয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বারডেম কর্তৃপক্ষ মৃতদেহটি আমাদের কাছে দিয়ে গেছে। মৃতদেহটি ফ্রিজে রাখা আছে। আরেকটি মরদেহ ২০১৬ সাল থেকে আমাদের এখানে রয়েছে। আরেকটি মার্কিন নাগরিকের মরদেহ। সেটি রয়েছে ২০১৮ সাল থেকে।’
সেকান্দার আলী বলেন, ‘এক বছর আগেও মৃতদেহগুলো নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। অনেক সময় মর্গের ফ্রিজগুলো বিকল হয়ে থাকতো দীর্ঘদিন। বর্তমানে আমাদের পাঁচটি মরচুয়ারি রয়েছে। যেখানে বিশটি পর্যন্ত মৃতদেহ সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু এক মাস যাবৎ তিনটি মরচুয়ারি বিকল অবস্থায় পড়ে আছে।’
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ মাকসুদের সাথে। তিনি বলেন, ‘গত বছর আমি ঢাকা মেডিকেলে জয়েন করেছি। তিনটি মৃতদেহের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। গতকালই জেনেছি। এর মধ্যে খোকন চৌধুরীর মৃতদেহ আট বছর ধরে আছে। এটা আদালতের বিষয়। আমাদের এখানে শুধু মৃতদেহ রাখতে বলা হয়েছে। আর কোনো কাজ আমাদের নাই। আদালত যখন চাইবে তখনই মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে।’
মরচুয়ারির বর্তমান অবস্থা জানিয়ে ডা. মাকসুদ বলেন, ‘পাঁচটির মধ্যে তিনটি বিকল থাকলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এটা ইলেক্ট্রিক জিনিস। নষ্ট হতে পারে। বিষয়টি কতৃপক্ষকে জানালে মেরামত করে দেয়। এ বছর আমাদের মর্গে রেসকোর্স থেকে একটি কোল্ড স্টোরেজ দিয়েছে। সেখানে ৪০টি মৃতদেহ সংরক্ষণ করা যাবে। যেটা বর্তমানে চালু করা হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা মৃতদেহই পাচ্ছি না।’
সারাবাংলা/এসএসআর/পিটিএম