১ মিনিটেই শেষ সব টিকিট
১৮ এপ্রিল ২০২২ ২৩:১৮
ঢাকা: সেহেরি খাওয়ার পর থেকেই ফোন হাতে নিয়ে অ্যাপসে ঢুকে বসেছিলেন ফাতেমা-রুবেল দম্পতি। ভোর ৬টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তারা প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করলেন। তখন অ্যাপস থেকে বার বার দেখানো হচ্ছিল সকাল ৮টায় শুরু হবে টিকিট দেওয়া। এর পর সকাল ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লিক। কিন্তু তথ্য লোড হতে সময় নিচ্ছে। অবশেষে লোড হতে এক মিনিট সময় নিল। ততক্ষণে সব টিকিট শেষ। লেখা এলো টিকিট জিরো, অর্থাৎ আর কোনো টিকিট নেই।
এভাবেই সোমবার (১৮ এপ্রিল) সকালে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট এক মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। ওই দম্পতির অভিযোগ, এক মিনিটের মধ্যে কীভাবে সব টিকিট শেষ হয়ে যায়? এটা অসম্ভব ব্যাপার! অন্য কোনো ঝামেলা আছে। পূর্বের মতোই টিকিট আগে কেটে নেওয়া হচ্ছে। আগে সিএসএন কর্তৃপক্ষ এই কাজ করতো। আর এখন করছে সহজ ডটকম। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। তা না হলে যারা সময় বাঁচাতে অনলাইনে টিকিট কাটতে চান তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।
রুবেল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ইদে তিনি তার পরিবারকে গ্রামে পাঠাবেন। সেজন্য তিনি আগামী ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেনার জন্য অনলাইনে চেষ্টা করেন। প্রথমে তিনি এসি বাথ, পরে এসি চেয়ার ও শোভন চেয়ার সিটের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। একইভাবে ২১ এপ্রিলের টিকিটের জন্যও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি।
ফাতেমা-রুবেল দম্পতির মতো মিতা-তোফায়েল ও রিয়া-মিজু দম্পতিও অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদেরও অভিযোগ, নিশ্চয়ই কোনো কারসাজি রয়েছে। তা না হলে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে কিভাবে এতগুলো টিকিট শেষ হয়ে যায়।
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারগুলোর সামনে সারি সারি মানুষের দীর্ঘ লাইন। এসি বাথ এবং এসি চেয়ারের লাইনে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা নিরুপায় হয়ে ফিরে আসছেন। আর যারা শোভন চেয়ারের জন্য দাঁড়িয়েছেন তাদের অনেকেই সিট পেয়েছেন। আবার অনেকে দাঁড়ানো টিকিট নিয়েছেন।
কীভাবে এক মিনিটের মধ্যে অনলাইনের সব টিকিট শেষ হয়ে যায়?— এর উত্তর জানতে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরোয়ারের কক্ষে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার কক্ষেও বসে আছেন ২০/২৫ জনের এক দল ভুক্তভোগী। তারাও টিকিট প্রত্যাশী বলে জানান। তাদের অনেকেই মাসুদ সরোয়ারকে ফোন করেও পাচ্ছেন না। ফোন বন্ধ রেখেছেন তিনি। প্রায় ঘণ্টাখানেক থেকেও স্টেশন ম্যানেজারকে পাওয়া গেল না।
স্টেশন ম্যানেজারের এক সহকারীর কাছে জিজ্ঞেস করলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘স্যার ফোন বন্ধ করে কোথাও গিয়ে বসে আছেন। কারণ এই সময়টাতে সবাই তাকে ফোন করে জ্বালাতন করে। সবাই টিকিট চায়। সবাই তার কক্ষে আসে টিকিটের জন্য। কিন্তু তিনি কি টিকিট দিতে পারেন? দুয়েক জনকে হয়তো সহায়তা করে থাকেন। এই সুযোগে অনেকেই আসে। বেশির ভাগই ফোন করে টিকিট চায়।’
এদিকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত রেল পুলিশের এক সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রেনের টিকিট এখন ভিআইপি আর ভিভিআইপিদের জন্য। তারা এসি বাথ আর এসি চেয়ারের সব টিকিট নিয়ে নেন। আগে সিএনএস কর্তৃপক্ষ রাতে বেশির ভাগ টিকিট কেটে রাখতেন। সকালে অনলাইনে যারা ঢুকতেন তারা আর টিকিট পেতেন না। সংকট নিরসনে সিএনএসকে বাদ দিয়ে সহজ ডটকমের হাতে টিকিট তদারককারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখভালের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে। অথচ সিএনএস’র চেয়েও যাত্রীদের বেশি ভোগান্তিতে ফেলছে সহজ ডটকম। কেউ রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না, কেউ টিকিট কাটতে পারছেন না। মাত্র কয়েক দিন হয়েছে ওয়েবসাইট কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতেও সেই আগের মতোই টিকিট উধাও হয়ে যাচ্ছে।’
রেল পুলিশের ওই সদস্য আরও বলেন, ‘সহজ ডটকম কর্তৃপক্ষ চাহিদা মতো রাতের বেলায় টিকিট কেটে রাখছেন। পরদিন সকাল ৮টার দিকে অনলাইনে টিকিট কাটতে গেলে তা আর মিলছে না। সবগুলোই সোল্ড দেখায়। মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ে কীভাবে এতগুলো টিকিট উধাও হয়ে যায় সেটা নিয়েই রীতিমতো দিশেহারা যাত্রীরা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র অনলাইনের টিকিটগুলোই আগের রাতে কেটে নেওয়া হচ্ছে। আর এই কাজটি সহজ ডটকম করছে— এমনটাই দাবি ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে কথা বলতে স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় সহজ ডটকমের অফিসে কর্মরতদের কাছে গেলে তারা কেউই কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেলের কর্মকর্তারাই টিকিট বরাদ্দ চেয়ে কাগজপত্র পাঠান। আমরা শুধুমাত্র চাহিদা পূরণ করি। এতটুকু জেনে রাখেন, আমরা কেউ টিকিট নিই না। এবং কেউ কোথাও বিক্রিও করি না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সহজ ডটকমের কিছু সমস্যা ছিল। গত কয়েকদিনে তা কেটে উঠেছে। আমরাও তদারকি করছি, যাতে সব ঠিকঠাক ভাবে চলে। টিকিট উধাও হয়ে যাচ্ছে— এমন কথা আপনার মুখে শুনলাম। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম