সিন্ডিকেট ইস্যুতে মতানৈক্য, আটকে গেছে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি
২০ এপ্রিল ২০২২ ২২:২৭
ঢাকা: কথা ছিল চুক্তির কিছু দিনের মধ্যেই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে শুরু করতে পারবে বাংলাদেশ। কিন্তু চার মাস পেরিয়ে গেলেও সে প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে বসে আছে মালয়েশিয়া। তাহলে কর্মী পাঠাতে বাধা কোথায়?
সূত্র বলছে, মালয়েশিয়া চায়— হাতেগোনা কয়েকটি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারবে দেশটিতে। সেই মতে সুর মেলাচ্ছেন বাংলাদেশের জনশক্তি ব্যাবসায়ীদের একাংশও। তারা আগের মতোই সীমিতসংখ্যক এজেন্সি মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে চান। আর সরকার চায়, নিবন্ধিত সব এজেন্সিই কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দ্বন্দ্বেই বলতে গেলে আটকে রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এ পরিস্থিতিতে সিন্ডিকেটের পক্ষে কাজ করতে ঢাকা সফরে এসেছেন মালয়েশিয়ার সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী তাজউদ্দীন বিন আবদুল রহমান।
দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য জনশক্তির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। জানা যায়, ওই সময় মাত্র ১০টি এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেত। এগুলো হলো— ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেড, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, আল ইসলাম ওভারসিজ, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসালট্যান্টস লিমিটেড, আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস ও শানজারি ইন্টারন্যাশনাল।
তখন ওই ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পৌনে তিন লাখ কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়। ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয়ের কথা বলা হলেও একেকজন কর্মীকে মালয়েশিয়া যেতে খরচ দিতে হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে ওই সময়ে। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় আর নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তৎকালীন মাহাথির সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মী পাঠানোর চুক্তি বাতিল করে এবং কর্মী নেওয়াই বন্ধ করে দেয়।
এরপর ২০১৮ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে বাংলাদেশি কোনো কর্মী যেতে পারছেন না। এরপর গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ফের আলোচনা করে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ। ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর জানুয়ারি থেকে কর্মী পাঠাতে প্রস্তুতিও শুরু করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এবারেও সেই সিন্ডিকেট ইস্যুতেই আটকে গেছে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির প্রক্রিয়া।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে— বাংলাদেশের মাত্র ২৫টি এজেন্সি তাদের এজেন্টদের দিয়ে কর্মী পাঠাতে পারবে। আর এ নিয়েই বেঁধেছে বিপত্তি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এবার কর্মী পাঠাতে সুযোগ পাবে দেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সি। গত বৃহস্পতিবারও এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আবারও বলেছেন, যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে, সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আর কর্মী পাঠাবে না বাংলাদেশ। এ কারণে মালয়েশিয়া যদি নেপাল কিংবা অন্য কোনো দেশ থেকে কর্মী নিতে চায়, তবে নিতে পারে।
জানা গেছে, তখন ওই ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক দাতো নূর আমিন ও বাংলাদেশের রুহুল আমীন স্বপন। অভিযোগ রয়েছে, এবারও তারা সিন্ডিকেট করতে চাপ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দিতে না পারলে নেপাল ও ভারত থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নেবে— এমন প্রচারণাও সরকারি ও বেসরকারি মহলে চালানো হচ্ছে ওই মহলের পক্ষ থেকে।
এদিকে, মালয়েশিয়ার সাবেক মন্ত্রী সংসদ সদস্য হাজী তাজউদ্দিন বিন আবদুল রহমান বর্তমানে ঢাকা সফরে রয়েছেন। তিনি ২৫টি এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটের হয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করছেন বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক সরকারের উপ-কৃষিমন্ত্রী ছিলেন এই তাজউদ্দিন।
জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, হাজী তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়াতেও নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিন্ডিকেটের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশ সরকারের অনেকের সঙ্গে দেখা করে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। রুহুল আমিন স্বপনদের আয়োজিত ইফতার পার্টিতেও তিনি হাজির ছিলেন মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল)। এর বাইরে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিনের সঙ্গে দেখা করার সময়ও নিয়েছেন তিনি।
বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক রুহুল আমীন স্বপন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ার সাবেক যে মন্ত্রী ঢাকায় এসেছেন, তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসার কাজেই ঢাকা এসেছেন।’ মঙ্গলবারের ইফতার আয়োজনে হাজি তাজউদ্দিনের উপস্থিত থাকার তথ্যও অস্বীকার করেছেন স্বপন।
তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ বেসরকারি সফর। শুনেছি, তিনি অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছেন। তবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সঙ্গে তার (হাজি তাজউদ্দিন) ঢাকা সফরের কোনো সম্পর্ক নেই।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার প্রসঙ্গে স্বপ্ন বলেন, ‘দেশ ও কর্মীদের স্বার্থে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া উচিত। সরকার যে প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠাতে বলবে, আমরা সেভাবেই পাঠাব।’ তবে নেপাল ও ভারত থেকে মালয়েশিয়ার কর্মী নেওয়ার বিষয়টিকে তিনিও গুরুত্ব দিচ্ছেন। বলেন, ‘এরই মধ্যে ভারত-নেপাল থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নিতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি আমরা দেরি করলে বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে।’
সূত্রগুলো বলছে, ২০১৫ সালের মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন বারিশান ন্যাশনাল জোট সরকার গত বছর ক্ষমতায় ফিরে আগের পদ্ধতিতেই কর্মী নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে এবার ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে আরও ১০টি করে সাব-এজেন্টসহ মোট ২৭৫টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশকে পাঠানো এক চিঠিতে এমন প্রস্তাব করেন সেখানকার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারভান। চিঠির জবাবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ লিখেছেন, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার সীমিতসংখ্যক এজেন্সি দিয়ে কর্মী পাঠাতে পারে না। আইন অনুযায়ী বৈধ লাইসেন্সধারী সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সমান সুযোগ দিতে হবে।
জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংখ্যা দেড় হাজার। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী এর মধ্যে মাত্র ২৫টি এজেন্সি জনশক্তি রফতানির সুযোগ পেলে অভিবাসন ব্যয় বাড়বে বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা। ফলে শ্রমিকদের জন্য সহজে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগই বন্ধ হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। অভিবাসন ব্যয় বেড়েছে। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর জন্য বাজার চালু করা গেলেও সেই বাজার ধরে রাখা যাবে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার চালু হলে যে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী— প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার শ্রমবাজার শ্রমশক্তি রফতানি সিন্ডিকেট ইস্যু