ত্রুটি প্রতিষ্ঠানের, ঝুঁকিতে কেয়ার মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ
২১ এপ্রিল ২০২২ ১৩:১৫
ঢাকা: ২০১৩ সালে রাজধানীতে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের ভর্তি শুরু হয়। তবে নীতিমালা অনুযায়ী নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস না হওয়া, শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকার পাশাপাশি রোগীর স্বল্পতা থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০১৭ সালে কেয়ার মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তবে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হলেও এসব ক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদন। এমন অবস্থায় অনিশ্চয়তা ও হুমকির মুখে চিকিৎসক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। শুধুমাত্র ২০১৭ সাল পরবর্তী সময়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশন পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎও প্রায় অনিশ্চিত বলে শঙ্কা জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ভর্তি করালেও কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে নারাজ। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মাইগ্রেশনের দাবি জানানো হলেও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর বলছে, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে মাইগ্রেশনের সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বিএমডিসি বলছে, কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক বছর ধরেই নানা সমস্যা চলছে। একাধিকবার পরিদর্শন শেষে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের কথা বলা হলেও কার্যত কোনো ধরনের পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সমস্যাগুলো সমাধান না করলেও আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে কেয়ার মেডিকেল কলেজ উলটো শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে থাকে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই। আর এসব সংশোধন না হওয়ার কারণে অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই।
কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। কিন্তু দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে পরীক্ষা প্রায় আট মাস পিছিয়ে যায়। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আমাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় যার ফলাফল প্রকাশ করা হয় একই বছরের ১৮ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সকল সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ শুরু হয় ১ নভেম্বর থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছয় মাস পার হলেও আমাদের সেই সৌভাগ্য এখনো হয়নি।
কেয়ার মেডিকেল কলেজের আরেক শিক্ষার্থী শুভ সারাবাংলাকে বলেন, বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশনের আওতায় না থাকার কারণে আমরা ইন্টার্নশিপ করতে পারছি না-কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের এমনটাই জানিয়েছিল। কিন্তু কিভাবে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসা যায় সে বিষয়ে আমাদের কিছুই বলেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। উলটো তারা আমাদের বলে হাসপাতালে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রথমদিকে তাও বলতো যে ডিসেম্বরের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা হবে যদি আমরা ডিউটিতে জয়েন করি। আমাদের অভিভাবকদেরও একই কথা বলত। পরবর্তীতে ডিউটিতে জয়েন করলেও দেখা যায় কোনো পদক্ষেপ তারা নেয় নাই। উলটো প্রায় ১৯-২০ দিন ডিউটি শেষে যখন কোনো অগ্রগতি দেখা যায় নাই তখন আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানাই বিষয়টি।
তিনি বলেন, জানানোর পর কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের অভিভাবকদেরও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যান। ইন্টার্নশিপ কবে শুরু হবে- এমনটা জানতে চাইলেই আমাদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. পারভিন ফাতিমা নানা রকমের আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে আমরা হাসপাতালের পরিচালক ডা. গোলাম মোর্শেদ সুমনের সঙ্গে দেখা করি। একইসঙ্গে কলেজ সচিব মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গেও দেখা করি। তারা জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে বিএমডিসি থেকে কলেজ পরিদর্শন করা হবে। এরপরেই আমাদের ইন্টার্নশিপ শুরু করা হবে। কিন্তু সেই দিন আর এখনো আসে নাই।
তিনি আরও বলেন, এক পর্যায়ে আমাদেরকে বলা হয় ডিজিতে (স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর) গিয়ে সমস্যা সমাধান করার জন্য। সেখানে গেলে আমাদের বলা হয় বিএমডিসিতে যোগাযোগ করার জন্য। এই দুই স্থানে গিয়ে জানতে পারি কেয়ার মেডিকেল কলেজের কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ত্রুটি এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অসঙ্গতি থাকার কারণে বিএমডিসি কেয়ার মেডিকেল কলেজকে রেজিষ্ট্রেশন দেয়নি। পরবর্তীতে আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে মাইগ্রেশনের দাবি জানাই। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ইন্টার্নশিপের অপেক্ষায় থাকা ব্যাচের মাইগ্রেশনের জন্য রাজি হয়। তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএমডিসির কাছে লিখিত আবেদন জানান। তবে এর বেশি আর কোনো সাহায্য করেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
একই ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, মাইগ্রেশনের জন্য কোনো সাহায্য না করলেও কলেজের অধ্যক্ষ ডা. ফারহানা সালাম জানিয়েছেন আমাদের কোনো দায়িত্ব তাদের উপর বর্তায় না। আর এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা তাদের কোনো দেখা পাই না। হাসপাতাল পরিচালকের দেখা মিললেও তিনি বলেন কলেজের কোনো বিষয়ে তিনি জানেন না।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষক স্বল্পতা, মানহীন ল্যাব ও হাসপাতালে রোগী না থাকাসহ একাধিক অভিযোগ পাওয়া যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছে এমন প্রশ্নের উত্তর চাইতে একাধিকবার কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলেও দেখা মেলেনি কর্তৃপক্ষের।
কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. ফারহানা সালামের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
একইভাবে কেয়ার মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান ডা. পারভিন ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
দুইজনের কাছেই এসএমএস’র মাধ্যমে উত্তর জানতে চাওয়া হলেও এর কোনো উত্তর পাওয়া যায় নি।
শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করলেও ইন্টার্নি করতে পারছে না। এমন অবস্থায় মাইগ্রেশনও চাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কলেজ কর্তৃপক্ষ সাহায্য না করলেও সরকারিভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর ও বিএমডিসি থেকে কিছু করণীয় আছে কিনা জানতে চাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ বিষয়ে বিএমডিসি’র ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. আরমান হোসেন বলেন, দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় পরিচালনা করা হয়ে থাকে। কেয়ার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে আমাদের এখান থেকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যবেক্ষণের জন্যেও যাওয়া হয়েছে একাধিকবার। সেখানে নানা বিষয়ে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে অসঙ্গতি দূর করার জন্য। কিন্তু সেগুলো করা তো দূরের কথা বরং কোনো পদক্ষেপ তাদের নিতে দেখা যায় নি।
বিএমডিসি’র স্থায়ী স্বীকৃতি প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় পরিচালনা করা হয়ে থাকে। সেই নীতিমালার আওতায় বিএমডিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর তদারকি করবে। কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি অনুমোদনের পরে যেসব নীতিমালা পূরণ করতে বলা হয় সেখানে কিছু অসঙ্গতি দেখা যায়। যেমন নীতিমালা অনুযায়ী সেখানে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল থাকতে হবে যেখানে ১০ শতাংশ গরীব রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ থাকতে হবে। একইসঙ্গে নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষকসহ অন্যান্য কাঠামোগুলোও পূরণ করতে হবে। কিন্তু এটা শুরু করার পর থেকে বিএমডিসি একাধিকবার সতর্ক করলেও সেগুলো পূরণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, কেয়ার মেডিকেল কলেজে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যা যা থাকার কথা তার কিছুই নেই। ২০১৬-১৭ সেশনে অনিয়মের কারণে দেশের ছয়টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি বন্ধ করে দেয়। এর মাঝে একটি হলো এই কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বিএমডিসি’র অনুমোদন না থাকলেও আদালতের অনুমতি নিয়ে কেয়ার মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে না তাই। তবে মাইগ্রেশনের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন বিষয়। এক্ষেত্রে যদি কলেজ বন্ধ করা হয় তবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত বিবেচনাও মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন বিষয় হবে।
তবে বর্তমান সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী মাইগ্রেশনের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিকেলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য বিএমডিসি’র যে নীতিমালা রয়েছে সেখানে এক মেডিকেল কলেজ থেকে আরেক মেডিকেলে মাইগ্রেশনের কোনো সুযোগ নেই। কেয়ার মেডিকেল কলেজকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয় নাই। তাদের অনুমোদন স্থগিত করা হয়েছে। সেই হিসেবে আসলে যাদের আমরা অনুমোদন দেই নাই তাদের বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। তবে যে ১৮০ জন শিক্ষার্থী কেয়ার মেডিকেল কলেজে পড়ছিল মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের জন্য কি করা যায় সেটি আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
সারাবাংলা/এসবি/এসএসএ