Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধোবাউড়ায় নির্বিচারে সাদা মাটি উত্তোলনে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৪ এপ্রিল ২০২২ ১১:১১

ঢাকা: একটি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে দুই বছর ধরে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে সাদামাটির পাহাড়ে খননের কাজ বন্ধ থাকলেও তা অবাধে চলছে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়। ফলে বিপন্নতার মুখোমুখি সেখানকার প্রতিবেশ ও জনজীবন। ১০ সদস্যের এক নাগরিক প্রতিনিধি দলের সাদামাটি পরিদর্শন শেষে একমত বিনিময়সভায় এসব দাবি করা হয়।

সভায় জানানো হয়, চারটি বেসরকারি সিরামিক প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে পাহাড় লিজ নিয়ে মাটি খনন করলেও মানা হচ্ছে না নির্ধারিত ৩১টি নীতিমালার কোনোটিই। যথেচ্ছভাবে পাহাড় কাটার ফলে স্থানীয় প্রাণ ও প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে এসব এলেকা থেকে ৫২টি পরিবার যাদের মধ্যে ৪২টি আদিবাসী ও ১০টি মুসলমান পরিবার উচ্ছেদের শিকার। এদের মধ্যে কোনো কোনো পরিবার আবারও দ্বিতীয় দফায় উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। নেই সরকারি কোনো পর্যবেক্ষণও।

শনিবার (২৩ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরেজমিনে পরিদর্শন দলের বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) করা রিট পিটিশনের (নং ১১৩৭৩/২০১৫) প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার মেজপাড়া, আরাপাড়া ও পাচকানাইহা মৌজা থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ব্যতীত এবং নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কেটে সাদামাটি আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এমন কাজকে জনস্বার্থের পরিপন্থী বলে আখ্যা দেন। এর ফলে দূর্গাপুরের উল্লেখিত মৌজাসমূহে সাদামাটি আহরণ প্রায় ২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এদিকে অনতিদূরে অবস্থিত ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় একই কায়দায় অপরিকল্পিতভাবে টিলা কেটে এখন সাদামাটি উত্তোলন অব্যাহত আছে। দুটি জায়গারই একই পাহাড়, প্রকৃতি, এবং, জীববৈচিত্র্য ফলে ধোবাউড়াতেও নেত্রকোনার দূর্গাপুরের মত প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

দুর্গাপুরের তিনটি মৌজায় যেভাবে সাদামাটি আহরণ কাজ পরিচালিত হতো, ঠিক একইভাবে ধোবাউড়ায় খননকাজ চলছে। রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল অগ্রাহ্য করে টিলা কেটে চলছে সাদামাটি আহরণ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেশি মাটি উত্তোলন করে সময়মতো তা অপসারণ না করতে পেরে উত্তোলনস্থলে মাসের পর মাস স্তূপ করে ফেলে রাখা হচ্ছে। আবার উত্তোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে যে মাটি তোলা হয়, সেটা কাজে লাগে না বলে এখন কৃষিজমিতে ফেলে রাখা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মূল্যবান সাদামাটি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা না, উত্তোলনের যে নানামুখী প্রভাব রয়েছে সেসব একেবারেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। অথচ আহরণস্থলে সরকারি কোনো তদারকি নেই। পরিদর্শনকালে দেখা গেছে সাদা মাটি উত্তোলনের জন্য ধোবাউড়া উপজেলায় আরও কয়েকটি টিলা কেনা হলেও এখনও খনন শুরু হয়নি।

ধোবাউড়ার ভেদীকুড়া মৌজায় সাদামাটি আহরণের ফলে, স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী সেখানে প্রতিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এবং পাহাড় ও পাহাড়ী বনের উপর নির্ভরশীল হাজং, মান্দি ও অন্যান্য আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বন ও গাছপালা ধ্বংসপ্রাপ্ত, বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন, পানি দূষণ, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে খরগোশ পাওয়া যেত সেখানে আর খরগোশের দেখা যায় না। খননের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় কৃষিকাজ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে ও ভারী যানবাহনের কারণে শব্দ দূষণ ও রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। যে পাহাড় ও বন এই অঞ্চলের জানা ইতিহাসের পুরোটা সময় হাজং, গারো ও অন্যান্য আদিবাসীদের জন্য ছিল বাসযোগ্য নিজস্ব আবাসভূমি সেটাই এখন অপরিকল্পিত ও নির্বিচার সাদামাটি আহরণের ফলে ক্রমশ অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে।

মতবিনিময় সভায় মতিলাল হাজং বলেন, দুর্গাপুরে সাদামাটির উত্তোলনের ফলে অনেক আদিবাসী গারো, হাজং ও হাদি জনগোষ্ঠীর লোকজন উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের জমির কাগজ পত্র নাই এই হইল দোষ, টিলায় থাকে কিন্তু কাগজপত্র নাই।

তিনি বলেন, অনেক কোম্পানি আছে যারা ৫০০ টনের অনুমতি নিয়ে ৫০০০ টন উত্তোলন করে যা কেউ তদারকি করে না। আমি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাতে আমাকে নানানভাবে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করে গেছি।

আদিবাসী নেতা নু মং বলেন, যারা পরিদর্শনে গেছেন তাদের জানানো ন্যায্য দাবি সরকারের আমলে নেওয়া উচিত। নীতি নির্ধারকদের কাজ করা উচিত অবৈধভাবে সাদামাটির পাহাড় খননের বিরুদ্ধে।

প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, আমি জানতাম না সাদামাটি উত্তোলনের প্রভাব সম্পর্কে, প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গিয়ে তা প্রত্যক্ষ করে আসলাম, আগে দেখেছি সোমেশ্বরীর পানি পরিষ্কার ছিল। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম তা ঘোলা হয়ে গেছে। এমনভাবে সেখানে বালু উত্তোলন হয় মনে নদীর বুক-পিঠ মাংস খুবলে খুবলে খেয়ে নিচ্ছে যেন। এ কারণে কিন্তু পাড় ধসে পড়ছে। এ রকম চলতে থাকলে আগামীতে নদীর তীরে যাদের, বিশেষত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনের বাড়িঘর নাই হয়ে যাবে।

জাকির হোসেন বলেন, আমরা দেখছি দুর্গাপুরের যে সৌন্দর্য ছিল, তা আজ আর নেই। সাদামাটির পাহাড় আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদ হলেও স্থানীয়দের জীবন জীবিকা বসবাস ইত্যাদি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আগামীতে দুর্গাপুরের অবৈধ বালু উত্তোলনের ব্যাপারেও কথা বলব। এ সময় তিনি স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি করার প্রস্তাব দেন।

গত ৮-১০ এপ্রিল ১০ সদস্যের একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়ায় কয়েকটি সাদামাটি আহরণস্থল পরিদর্শন এবং স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশে এর প্রভাব অবলোকন করেন। উপজেলা দুটির কয়েকটি গ্রামের হাজং, মান্দি ও বাঙালি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি দুর্গাপুর প্রেসক্লাবে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে মতবনিমিয় এবং নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, আইনজীবী ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, সাংবাদিক নজরুল কবীর, সাংবাদিক ও গল্পকার রাজীব নূর, অনুবাদক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীব, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অনামিকা আহমেদ ও নাগরিক উদ্যোগের প্রতিনিধি ফারহান হোসেন জয়।

মতবিনিময় সভায় প্রতিনিধিদল পরিদর্শনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের কাছে বেশকিছু দাবি জানান। এগুলো হলো- ১. পরিবেশগত সুরক্ষার প্রশ্ন বিবেচনায় না নিয়ে অপরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের যে আয়োজন তা বন্ধ করতে হবে। ২. সাদামাটি উত্তোলনের ফলে যেসব আদিবাসী ও বাঙালি পরিবার বাস্তচ্যুত ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে। ৩. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যক্তিবর্গের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। ৪. পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্য ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করতে হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৫. পরিবেশ ও জৈববৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারসাম্যহীন উপায়ে করা খননকাজ এবং খননের পর বিদ্যমান কোনো প্রটোকল না মেনে সংশ্লিষ্ট জায়গা যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, সেটা পুনরায় জীববৈচিত্র্যের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এর আর্থিক দায়ভার খননকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। ৬. খননের ফলে সৃষ্ট খাদ বা খাদের পানিতে পড়ে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করার পাশাপাশি এই পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন সেসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. সোমেশ্বরী নদী হতে বালু উত্তোলনের প্রক্রিয়াও পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। বালুর ট্রাক চলাচলের ফলে দূর্গাপুরবাসী প্রতিদিন যে দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হন তা লাঘব করার জন্য একটা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ৮. প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশের উপর যেন প্রতিকূল প্রভাব না পড়ে তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। ৯. খনন কাজের সময় স্থানীয় পর্যায়ে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো মনিটরিং থাকে না যা নিশ্চিত করতে হবে। এবং পর্যটন ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। ১০. মাটি উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি প্রাপ্তি এবং স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যমান আইএলও কনভেনশন একদমই মানা হচ্ছে না। শ্রমিকদের এই স্বার্থের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে বিস্তারিত আলোচনা করেন সংস্কৃতিকর্মী ও আদিবাসী নেতা মতিলাল হাজং, আইনজীবি ও সাংবাদিক প্রকাশ বিশ্বাস, লেখক ও সাংবাদিক নজরুল কবির, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমীলা, প্রমুখ। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন।

সারাবাংলা/আরএফ/এএম

ধোবাউড়া সাদামাটি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর