Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেলায় উৎসবের আমেজ, সোমবার বলিখেলা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৪ এপ্রিল ২০২২ ২০:২২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দুই বছর বন্ধ থাকার পর ফের শুরু হওয়া আব্দুল জব্বারের বলিখেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলায় দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক, ক্রেতার বচসা, বাঁশির সুর, খেলনার টুং টাং শব্দ- সব মিলিয়ে এই মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে বন্দরনগরীতে। তবে মেলায় এবার দোকানপাট অন্যান্যবারের চেয়ে কম।

আয়োজকরা বলছেন, বলিখেলা ও মেলা আদৌ হবে কি না দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা, রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় বিক্রেতার সমাগম এবার কম হয়েছে।

রোববার (২৪ এপ্রিল) ভোর থেকে নগরীর লালদিঘী পাড়ের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও বিক্রেতাদের অধিকাংশই সড়কে বসেছেন অন্তত দু’দিন আগে থেকে। সোমবার বিকেলে ঐতিহাসিক বলিখেলা অনুষ্ঠিত হবে। লালদিঘীর পাড় গোলচত্বরে ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে।

দুপুরে মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, হাঁড়ি পাতিল, সরা, শিক্কা, বাসন-কোসনের দোকানের পাশাপাশি মেলায় এসেছে মাটির পশু-পাখি, ফল-ফলাদি, নকশি কাঁথা, নকশি পাটি, নকশি পাখা। ছাঁচে তৈরি মিষ্টিদ্রব্য-চিড়ার নাড়ু, নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ি মুড়কি, খাজা-গজা, নকুলদানা, জিলাপি যথারীতি বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ডুগডুগি, একতারা, দোতারা, বাঁশি, ঝাড়ু, দা-বটি, কাঠের আসবাবপত্র- সব মিলিয়ে হাজারখানেক স্টল বসেছে মেলায়।

কুমিল্লার হোমনা থেকে বিভিন্ন ধরনের বাঁশি নিয়ে এসেছেন লিটন। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে নিজেই তুলছেন সুর। নিজের তৈরি প্রায় ৫০০ বাঁশি নিয়ে এসেছেন মেলায়। তিনদিনে সব বাঁশিই বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে পারবেন বলে আশা লিটনের।

নরসিংদী থেকে মোহাম্মদ সোহেলের নেতৃত্বে আসা নয় জন দু’টি দোকান দিয়েছেন কে সি দে রোডে। সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার দোকান কম। সবাই আসেনি। এবার বিক্রি ভালো হবে বলে আশা করছি।’

কুষ্টিয়ার পান নিয়ে এসেছেন সুধীর দাস। ঢাকা থেকে ফুলের ঝাড়ু, বেতের ঝুড়িসহ গৃহস্থালী নানা সামগ্রী নিয়ে এসেছেন লায়লা বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গত শুক্রবার এসেছি। দোকানও শুক্রবার থেকে চলছে। শুরু থেকেই বিক্রি হচ্ছে। এবার কাস্টমার মোটামুটি আছে।’

বরিশাল থেকে নিজের হাতে তৈরি মাটির তৈজসপত্র নিয়ে এসেছেন তমাল পাল। লালদিঘীর পাড়ে খোলা তার দোকানে মিলছে মাটির তৈরি খেলনাও। তিনি জানালেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ছাড়া অন্তত ৪০ বছর ধরে তিনি মেলায় আসছেন।

২৫০ পিস বেতের হাতপাখা নিয়ে গাজীপুর থেকে এসেছেন আমির হোসেন। তার দোকানে আছে বিভিন্ন কারুকাজের তালপাতার পাখাও।

দা-ধামা, কুড়াল, শিল-নোড়া নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থেকে এসেছেন পিন্টু দাশ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাস্টমার বেশি নাই। দিনে গরম বেশি। রোদ অনেক বেশি। সেজন্য কাস্টমার আসছে না। আমি যেসব জিনিস এনেছি সেগুলোর কাস্টমার মহিলারা। তারা সন্ধ্যার পর কিংবা ভোরের দিকে একটু গরম কমলে আসবে আশা করি।’

জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার দোকান কিছুটা কম। প্রথমত, করোনার কারণে দুইবছর মেলা বন্ধ ছিল। এবার হবে কি না সেটা নিয়ে একটা সংশয় ছিল। এরপর রমজানের মধ্যে এবার মেলা আয়োজন করতে হয়েছে। বিক্রেতারা মেলার বাইরেও ঈদ উপলক্ষে নিজ নিজ এলাকায় কিংবা বড় শহরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাবাণিজ্য করেন। সে কারণে তারা মেলায় আসতে আগ্রহ দেখাননি। তবে করোনা কাটিয়ে আমরা এই ঐতিহাসিক আয়োজনটা শুরু করতে পেরেছি- এটাই বড় কথা।’

রোববার দুপুরে মেলা পরিদর্শন করতে যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, ‘দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের লোকজন বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতে এসেছেন। আমরা যারা শহরবাসী, আমরা আমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, গ্রামীণ মেলার যে সংস্কৃতি সেটা ভুলে যাচ্ছি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা আমাদের সেই ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। একইভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেসব পণ্য প্রয়োজন সেগুলো বিক্রি করছেন। আমাদের সবার উচিত তাদের সহযোগিতা করা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এই মেলায় অংশগ্রহণ করা।’

বলিখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ। সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানার নিয়মিত দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের বাইরে অতিরিক্ত ফোর্স মেলা উপলক্ষে মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।’

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় কোনো ধরনের চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এখানে যেসব দোকান বসেছে, সেগুলো সড়কে সরকারি জায়গার ওপর বসেছে। সুতরাং দোকান বসানোর নামে কারও কাছ থেকে অর্থ আদায়ের সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

এদিকে মেলা কমিটির পক্ষ থেকেও দিনভর কারও সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো অর্থ লেনদেন না করার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে সিএমপির পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। কোনো অভিযোগ থাকলে ০৩১-৬৩০৩৫২, ০৩১-৬৩০৩৭৫, ০৩১-৬৩৯০২২, ০১৩২০০৫৭৯৯৮ এবং জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ যোগাযোগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সিএমপি।

বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর কুস্তির প্রবর্তন করেছিলেন যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘বলিখেলা’ নামে পরিচিত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলিখেলার সূচনা করেন তিনি। সূচনার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলিখেলা।

করোনার সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর বলিখেলা ও মেলা হতে পারেনি। এবার মেলার ১১৩ তম আসর হওয়ার কথা থাকলেও বলিখেলার ভেন্যু লালদিঘী মাঠ সংস্কারের কারণে বন্ধ থাকায় এ আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আয়োজকরা বলিখেলা ও মেলা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলিখেলা ও মেলার আয়োজন করেন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

জব্বারের বলিখেলা টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর