সাংবাদিকরা কবে নিরাপত্তা পাবে?
২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৭:১৮
সাংবাদিকতা মানে জান ও জবানের স্বাধীনতা।
সাংবাদিকদের কাজ সংবিধান অনুযায়ী প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা। সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। ভয় না করে জয় করাই সাংবাদিকতা অর্থাৎ হেরে না গিয়ে কলমের কালি দিয়ে সমাজের সত্য ঘটনা বর্ণনা করা। ফলে এটি অত্যন্ত মহৎ পেশা এবং সম্মানের জায়গা। কিন্তু যখন কোনো দেশে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা না থাকে। তখন সাংবাদিকতা হয়ে দাঁড়ায় খাঁচায় বন্দি পাখির জীবনের মতো।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যখন বাঙালিদের মাতৃভাষা বাঙলা ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল তখন বাঙালিরা মুখে মুখে রাজপথে স্লোগান তুলেন, “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” আমার ভাষা আমার অধিকার। নিজের মায়ের ভাষা কথা বলার জন্য রক্ত এবং জীবন দিতে হয়েছিল। আমাদের স্বাধীন দেশের পঞ্চাশ বছর এসে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে হচ্ছে রাষ্ট্রের বাকস্বাধীনতা নিয়ে।
‘আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করব না’ এমন কান্নাস্বরে বলেছিলেন সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম সরোয়ার। সারা দেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রগতিশীল মানুষ উদ্বিগ্ন।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের দোকানদার, হকার ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনকে গুরুতর অপরাধীর মতো ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং দোকান মালিক-শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের ইচ্ছে মত মারধর করছে। প্রশ্ন হলো, সংবাদ করতে যাওয়ায় কী অপরাধ?
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাউকে ছাড় না দিয়ে একজন সাংবাদিককে যখন ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখতে হয় তখন রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং জনপ্রতিনিধিরা সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেন এবং এমনকি হত্যাও করেন। এটাই শেষ নয় সারাজীবন মিথ্যা মালার ঘানি টানতে হয় প্রায় জীবনের অর্ধেক সময়।
আরএসএফের তথ্যের মতে গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪৮৮ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন। ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ২০ শতাংশ বেশি। সাংবাদিক গ্রেপ্তারে এগিয়ে থাকা তিনটি দেশই এশিয়ার। দেশগুলি হলো চীন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম। ইউনেস্কোর রেকর্ড করা এই তথ্যমতে, ২০০৪ – ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৪ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৪ এবং ২০১৫ সালে সাংবাদিক নিহতের ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এই পৃথক দুই বছরে ৫ জন করে মোট ১০ সাংবাদিক নিহত হন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে কোন সাংবাদিক হত্যা হয়নি। ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকারজনিত দেশের লাল তালিকায় নাম ওঠেনি বাংলাদেশের। তবে ২০০৫ এবং ২০১২ সালে তিনজন করে মোট ছয় সাংবাদিক নিহত হন। আর ২০১৬ এবং ২০২১ সালে হত্যার শিকার হয়েছেন দুইজন করে। একজন করে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ২০০৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০২০ সালে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একটি অনলাইন পোর্টালের প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ ওমর আসিফকে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন কর্তৃক মারধরের ঘটনায় আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আবার রাজধানীর হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ি এলাকায় ফুটপাতের পাশে রক্তাক্ত আহত অবস্থায় পড়েছিলেন দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবীবুর রহমান। পাশে তার মোটর মোটরসাইকেলটিও পড়ে ছিল। প্রথম দিকে গণমাধ্যমে দেখেছি সাংবাদিক হাবীবুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু যদি সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটে থাকে তাহলে তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান নি বরং তাকে হত্যা করা হয়েছে। কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে? তিনি কোনো প্রতিবেদন তৈরী করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন কি না? তার জন্য এই মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যববস্থা করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার ঝুলে থাকে। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কারণ, সাংবাদিকেরা আইনের ঊর্ধ্বে নন।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির একটি উদাহরণ বাংলাদেশের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনিকে ঢাকার রাজাবাজার এলাকায় তাদের অ্যাপার্টমেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সাংবাদিক সাগর – রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৮৫ বারের মতো পেছালো। আরও কতবার পেছাবে?
প্রায় এক যুগের কাছাকাছি সময়েও তদন্তকারীরা এখন পর্যন্ত মামলায় বলার মতো কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেননি কেন?। খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতির পরিবার এবং একমাত্র ছেলে ন্যায্য বিচার হতাশায় ভুগছেন। ৫ বছরের সেই ছোট্ট শিশু মেঘের বয়স ১৭ অতিক্রম করছে। সে দেখতে পাবে কী তার বাবা-মায়ের খুনিদের বিচার? মামলার তদন্তে নিয়োজিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কার্যক্রমে অগ্রগতি না হওয়া এবং আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বারবার সময় প্রার্থনা করায় তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, কোনো সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়নি বলে সাংবাদিক মহলে হতাশা প্রকাশ করছেন। আমাদের দেশে কী সাংবাদিক সুরক্ষা আইন আছে? বিশ্বের যেসব দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তার প্রমাণ হিসাবে সাগর – রুনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কী? লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যু কেন হয়েছিল? আর তাকে কোন আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল? লেখক মুশতাক গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন। তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী করা হয়েছিল। লেখক মুশতাকের অপরাধ কি ছিল? গণতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশের অন্যায় তো কিছু নয়। তাহলে এটা স্পষ্ট যে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, অমানবিক ও বর্বর আইনের নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
৫০ বছরের বাংলাদেশ, গণমাধ্যমের অর্জন ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনায় দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমের সম্পাদকেরা কথা বলেন৷ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নামে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে৷’’ তিনি আদালত বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘‘আপনারা দয়া করে একটু দেখুন, কিছু কিছু আইন আছে সেগুলো কীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে৷’’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানির মামলার আইনসহ স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বাধা তৈরি করে এমন সব আইন সংশোধনের দাবিও করেন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কালো আইন বাতিল করে মানুষের বাকস্বাধীনতার অধিকার দিতে হবে। হাবীবুর সহ আলোচিত হত্যাকাণ্ড সাগর – রুনির হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর কোনো সাংবাদিকের যেন রক্ত ঝড়ে না তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জান ও জবাবের স্বাধীনতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস