এপ্রিলে তীব্র তাপপ্রবাহ, মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের আভাস
২৬ এপ্রিল ২০২২ ১২:০১
ঢাকা: ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি ঝড়-বন্যা কবলিত মহাদেশ এশিয়া। প্রতিবছরই এই ঝড়-বন্যায় জনজীবনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। এবারও গ্রীষ্ম মৌসুম জুড়েই রয়েছে ঝড়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপের মতো পূর্বাভাস। পাশাপাশি তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ারও পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবই এই পরিস্থিতির কারণ।
আবহাওয়া অধিদফতরের দীর্ঘ মেয়াদি পূর্বাভাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি এপ্রিল মাসে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার কথা রয়েছে। এরমধ্যে এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কথা বলা হলেও, এ মাসে বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এ মাসে উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত ২ থেকে ৩ দিন মাঝারি বা তীব্র ধরনের কালবৈশাখী ঝড় বা বজ্রঝড় হতে পারে। এসময় দেশের অন্যান্য এলাকায় ৪ থেকে ৫ দিন হালকা বা মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী বজ্রঝড় হতে পারে।
এ মাসে ঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও আবার তাপপ্রবাহও বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সেখানে বলা হয়, এপ্রিল মাসে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। যার মাত্রা হতে পারে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের অন্য স্থানেও ১ থেকে ২টি মৃদু, যার মাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ সেলসিয়াস আর মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। যার মাত্রা হতে পারে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী, আসছে মে মাসেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কথা বলা হলেও এ মাসে বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এ মাসে উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত ২ থেকে ৩ দিন মাঝারি বা তীব্র ধরনের কাল বৈশাখী ঝড় বা বজ্রঝড় হতে পারে। এসময় দেশের অন্য এলাকায় ৩ থেকে ৪ দিন হালকা বা মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী বজ্রঝড় হতে পারে।
এপ্রিল মাসের মতো মে মাসেও উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ১ থেকে ২টি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। যার মাত্রা হতে পারে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের অন্য স্থানেও ২ থেকে ৩ টি মৃদু যার মাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ সেলসিয়াস আর মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। যার মাত্রা হতে পারে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, মে মাসে এপ্রিল মাসের চেয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হতে পারে। ঢাকায় ২৭৫ থেকে ৩০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ২৯২ মিলিমিটার। ময়মনসিংহে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ৩৮০ মিলিমিটার হলেও মে মাসে এই বিভাগে হতে পারে ৩৬০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। চট্টগ্রামে মে মাসে ২৯৫ থেকে ৩২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ৩১০ মিলিমিটার। মে মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সিলেটে হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪৮৫ থেকে ৫৩৫ মিলিমিটার। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ৫১০ মিলিমিটার। রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হতে পারে ১৮৫ থেকে ২০৫ মিলিমিটার। যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ১৯৬ মিলিমিটার। রংপুর বিভাগে মে মাসে ২৫০ থেকে ২৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান হওয়ার কথা ২৬১ মিলিমিটার।
খুলনায় সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কথা বলা হয়েছে ১৬৫ থেকে ১৮৫ মিলিমিটার। যদিও সেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ১৭৫ মিলিমিটার। আর বরিশালে ২৪৫ থেকে ২৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ২৬০ মিলিমিটার।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের ইন্টার গর্ভনমেন্টাল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়, পঞ্চাশের দশকের পর থেকে বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের পরিমান বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাবক হিসেবে মানব প্ররোচিত জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১০০ সালের মধ্যে যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ না থাকে, তাহলে ভারি বৃষ্টিপাতের পরিমান আরও বাড়বে।
এদিকে সম্প্রতি চীন থেকে প্রকাশিত সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে এশিয়া মহাদেশকে বৃষ্টিপ্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ২০২১ সালে বন্যার কারণে শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশে আর্থিক ক্ষয়- ক্ষতির পরিমান ৩ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। যদিও বাংলাদেশে ঝড় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক কমেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটা সময় ছিলো যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হতো। আর ওই দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকতেন নারী ও শিশুরা। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে সিপিপি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন’ দিবসে সিপিপিতে ১৮ হাজার ৫০৫ জন ‘নতুন নারী স্বেচ্ছাসেবক অন্তর্ভুক্তি’ উদ্বোধন করেন। এরপরে ধারাবাহিকভাবে নারী স্বেচ্ছাসেবকগণের গুনগত মানোনন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দুর্যোগ সাড়াদানে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্যও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবায় নারী নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য ‘সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক নির্দেশিকা ২০২১’ এ বিশেষ বিধান সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় সিপিপির ৭৬ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছে, যার অর্ধেক নারী। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। যা এখন পাস হওয়ার অপেক্ষায়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘এসব উদ্যোগে কারণে ঝড়-বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি সিংহভাগ কমে গেছে। উদ্যোগের কারণে মানুষ আগে দুর্যোগ সম্পর্কে জেনে যাচ্ছেন, নিজেকে সেভ জোনে নিয়ে পারছেন এবং সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছেন। এটা অনেক বড় সফলতা।’
তিনি আরও বলেন, “১৯৭০ সালে ঘুর্ণিঝড়ে নারী-পুরুষ মৃত্যুর অনুপাত ১৪:১, ১৯৯১ সালে ৫:১, ২০১৭ সালে ২:১, বর্তমানে এ অনুপাত ১:১ নেমে এসেছে। এ উদ্যোগেরই স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে ‘জাতিসংঘ জনসেবা পদক ২০২১’ দিয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক-নির্দেশনায়। আমরা আরও ঘূর্ণিঝড় শেল্টারহোম নির্মাণ করছি। বজ্রপাত প্রতিরোধেও প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এরইমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ রোল মডেল। চলমান উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি আরও কমে আসবে।’
সারাবাংলা/জেআর/এমও