‘অনৈতিক প্রস্তাবে’ রাজি না হওয়ায় নিয়োগ আটকে দেন ঢাবি শিক্ষক!
২৬ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৫৫
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবার চেয়ে ভালো ফল করলেও একজন শিক্ষকের ‘অনৈতিক প্রস্তাবে’ রাজি না হওয়ায় শিক্ষক পদে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এমআইএস) বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। অভিযুক্ত শিক্ষক হলেন বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন। এ সংক্রান্ত দুইটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই নারী শিক্ষার্থী। তার সবশেষ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগটিতে সম্প্রতি প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাওয়া দু’জনের নিয়োগ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।
মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য।
সিন্ডিকেট সভা সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাপক ড. আকরামের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় যৌন-নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ এবং এমআইএস বিভাগের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ।
এমআইএস বিভাগের ওই শিক্ষার্থী ২০১৯ সালের ১০ মে প্রথম এ সংক্রান্ত লিখিত অভিযোগ জমা দেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বরাবর। সবশেষ আজ মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর জমা দিয়েছেন দ্বিতীয় অভিযোগটি। দুইটি অভিযোগের কপিই সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত আছে।
২০১৯ সালের ওই অভিযোগপত্রে ওই শিক্ষার্থী লিখেছেন, ২০১৮ সালে শিক্ষক নিয়োগের আগে বিভাগের অধ্যাপক আকরাম হোসেন তাকে ‘অত্যন্ত অনৈতিক ও ঘৃণ্য প্রস্তাব’ দেন। নিয়োগ নিয়ে অধ্যাপক আকরামের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে ওই শিক্ষার্থী রাজি না হলে ড. আকরাম একপর্যায়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ ওই শিক্ষার্থীর।
অভিযোগপত্রে তিনি দাবি করেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে ও অবিবাহিত থাকায় সে সময় ওই ঘটনা কাউকে জানাতে পারেননি তিনি। তবে লিখিত অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তার কাছে ‘ভয়েস রেকর্ড’ সংরক্ষিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, ২০১৯ সালে সেই অভিযোগ জমা হওয়ার ঘটনায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কাছে ক্ষমা চান অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন। তবে এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ করেননি বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক শিবলী।
ভুক্তভোগী ওই নারী শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে জানান, চলতি বছরের ৩১ মার্চ এমআইএস বিভাগ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে ফের আবেদন করেন অভিযোগকারী ওই নারী শিক্ষার্থী। জানা গেছে, অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকারে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদনকারী আট প্রার্থীর মধ্যে ওই নারী শিক্ষার্থীসহ উপস্থিত ছিলেন পাঁচ জন। অন্যদিকে সাক্ষাৎকার বোর্ডের একজন সদস্য ছিলেন অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন। বোর্ডের সুপারিশে প্রভাষক পদে নিয়োগের সুপারিশ পান জাহাঙ্গীর আলম ও সুমাইয়া সিদ্দিকা নামের দুই প্রার্থী।
মঙ্গলবার ঢাবি উপাচার্য বরাবর ওই নারী শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, বিবিএ ও এমবিএ— দুই পর্যায়েই প্রথম স্থান অধিকার করার পরও নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আবারও আবদন করি এই ভেবে— যেহেতু তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন, এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বিবিএ ও এমবিএ— দুই পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অর্জন করা সত্ত্বেও আমাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।’ এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এবং মেধার মূল্যায়নের মাধ্যমে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনার আবেদন করেছেন তিনি।
ওই শিক্ষার্থীর এই অভিযোগপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এমআইএস বিভাগের প্রভাষক পদে সাক্ষাৎকার বোর্ডের সুপারিশ করা দুই প্রার্থীর নিয়োগ স্থগিত করেছে ঢাবি সিন্ডিকেট।
সভায় উপস্থিত একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, অভিযোগকারী ওই নারী শিক্ষার্থীর স্নাতক পর্যায়ে ৩.৮২ ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩.৮৫ সিজিপিএ পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। এ পরিস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে অভিযোগ আসার কারণে প্রভাষক পদে সুপারিশ পাওয়া দুই প্রার্থীর নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন বোর্ডের সভাপতি ও উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, নিয়োগে কোনো বৈষম্য হয়নি। সর্বোচ্চ নম্বরধারী দু’জনকে নিয়োগ বোর্ড নিয়োগের সুপারিশ করেছে। সুপারিশ করার পরদিন এক প্রার্থী অভিযোগটি করেছেন। সিন্ডিকেট সেজন্য নিয়োগটি আপাতত স্থগিত রেখেছে।
সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, ওই শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাকি প্রার্থীদের সুপারিশের বিপক্ষে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মঈনের একটি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার কথা ছিল বলেও আলোচনা হয়েছে সভায়। এ বিষয়ে জানতে ফোন দিলে অধ্যাপক ড. আব্দুল মঈনও রিসিভ করেননি।
এদিকে, ওই নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগকে ‘চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করছেন অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অভিযোগ দুইটির ভাষা দেখলেই বোঝা যায়— এটি কেবল চরিত্রহননের জন্যই করা হয়েছে। সবশেষ নিয়োগে যদি সে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যেত, সেক্ষেত্রে এসব অভিযোগ আসতই না। এগুলো ষড়যন্ত্র।’
অধ্যাপক আকরাম আরও বলেন, ‘অভিযোগ সত্য হলে এতদিন কেন গোপন রেখেছেন অভিযোগকারী? গতকাল চাকরি না পাওয়ার জন্যই আজকের এই অভিযোগ। তার অর্থ, চাকরি পেলে অভিযোগ দিতেন না। তাই আমি মনে করি, এ অভিযোগটি অগ্রহণযোগ্য ও সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ ২০১৯ সালে অনুষদের সাবেক ডিন এবং আজ উপাচার্যকে দেওয়া চিঠি— দু’টির মধ্যে কোনো মিল নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর
অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে অনৈতিক প্রস্তাব