বাপেক্সের মেহেরুলের ‘কারসাজি’— বিনা টেন্ডার ২৪৮ কোটি টাকার কাজ
২৮ এপ্রিল ২০২২ ১৯:৩৭
ঢাকা: বিনা টেন্ডারে বার বার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং সেই কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে রাষ্ট্রের শত শত কোটি লোপাটের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মেহেরুল হাসানের বিরুদ্ধে। তিনি টেন্ডার ছাড়াই আর্নিব এন্টারপ্রাইজকে এসব কাজ পাইয়ে দিয়েছেন এবং সেই কাজে অনিয়ম হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
জানা গেছে, ডিজিএম মেহেরুল হাসান ও আর্নিব এন্টারপ্রাইজ মিলে ২৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকায় নয়টি স্থানে জরিপ করেছে। এই জায়গাগুলোর মধ্যে কোনোটি বড় আবার কোনোটি অনেক ছোট। জায়গা যাই হোক না কেন প্রতিটির জন্য সমান যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক দেখানো হয়েছে। ফলে ব্যয়ের হারও সমান হয়েছে। যাতে অনিয়মের ছাপ স্পষ্ট।
অভিযোগ উঠেছে, আর্নিব এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেহেরুল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়া, শ্রমিক নিযোগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ২৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। যা বাপেক্সের ঊর্ধ্বতনদের রীতিমতো বিপাকে ফেলেছে। আর এই অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করেছে বাপেক্সে।
বাপেক্স বলছে, বিনা টেন্ডারে ত্রি-মাত্রিক ভূ-কম্পন জরিপের কাজ করেছে একটি কোম্পানি। প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে তদন্ত কমিটি। সারাবছর নয়টি স্থানে দৈনিক এক হাজার দুইশ’ শ্রমিক কাজ করেছে বলে দাবি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের। এমনকি নয়টি জরিপেই সমপরিমাণ যানবাহনের ব্যবহার দেখিয়েছে তারা। আর এসব তথ্য বাস্তবসম্মত মনে করে না বাপেক্সের তদন্ত কমিটি। এদিকে, বিনা টেন্ডারে দেওয়া কাজে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ২৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ করেছে বাপেক্স। এর ৯১ ভাগের কাজ শেষ হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাকি ৯ ভাগের জন্য বরাদ্দ ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এই হিসেব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সার্বক্ষণিক কর্মরত জনবল ছিল ১২০০ জন। এতে জনবল বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আর যানবাহনের ব্যয় দেখিয়েছে ৮০ কোটি টাকা। তবে জরিপ এলাকাগুলো মধ্যে ১৫০, ২০০, ৩০০ ও ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাও ছিল। সেখানেও একই শ্রমিক ও একই পরিমাণ যানবাহন দেখানো হয়েছে।
এদিকে, প্রকল্পে নিয়ম না মেনে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রথম ধাপে ২ কোটি ৮০ লাখ ও দ্বিতীয় ধাপে ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলো এখনও আসেনি। এছাড়া, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫৮ কোটি ৫০ লাখ এবং ১৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইছে বিদ্যু, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরকম একটি কোম্পানি এককভাবে অনেক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে! টেন্ডার হলেও বার বার একই কোম্পানি কীভাবে কাজ পায়? বিষয়গুলো এবার আমাদের নজরে এসেছে। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে একটি ভালো তদন্ত করতে চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি লিখিতভাবে জানাব।’
জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই প্রকল্পের কাজের ব্যয়ের অসঙ্গতি নিয়ে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাপেক্সের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনও জমা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিবেদন অনুযায়ী কাজ চলছে।’
এ বিষয়ে নিয়ে বাপেক্সের চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) মাহবুব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কাজে অনিয়মের বিষয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। সেই অনুযায়ী মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এছাড়া ওই প্রতিবেদনটি পরিচালনা পর্ষদের সভায় তোলা হবে। বিষয়টি নিয়ে সভায় আলোচনা হবে।’
জানতে চাইলে অভিযুক্ত উপ-মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল হাসান বলেন, ‘এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী আমার পেছনে লেগেছে। যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তা কল্পনাপ্রসূত। আমিও প্রতিকার চেয়ে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছি। দেখা যাক কী হয়।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম