আমলা থেকে রাজনীতিবিদ-অর্থমন্ত্রী— বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার মুহিতের
৩০ এপ্রিল ২০২২ ০২:১৯
প্রয়াত হয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা মুহিত ছিলেন এক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী। সরকারি চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু। আমলা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারসহ স্বাধীন বাংলাদেশেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। এরপর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কাজ করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে। সাফল্য পেয়েছেন সেখানেও।
৬৭ বছর বয়সে যখন মানুষ সব কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন ক্যারিয়ার শুরু করেন রাজনীতিবিদ হিসেবে। সাফল্য পেয়েছেন সেখানেও। দুই মেয়াদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য তিনি। টানা দুই মেয়াদে পালন করেছেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, সিলেটে। মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী ও বাবা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ। মা-বাবা দু’জনই সিলেট জেলার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
আরও পড়ুন- সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত আর নেই
সেই পরিবার থেকে উঠে এসে আবদুল মুহিত নিজেও রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। মা-বাবার ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার ভাই-বোনদের মধ্যে ছোট ভাই ড. এ কে আবদুল মোমেনও রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেট থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকেই তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পান। পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আবুল মাল আবদুল মুহিত তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন পাকিস্তান দূতাবাসে যোগ দেন। পরে পাকিস্তান কর্মপরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ও উপসচিব ছিলেন।
পাকিস্তান সরকারের আমলা হলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওয়াশিংটনে তৎকালীন পাকিস্তানের দূতাবাসে প্রথম কূটনীতিবিদ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন মুহিত। পরে ১৯৭১ সালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনমিক কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন আবদুল মুহিত। পর অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।
অবসরে গিয়েও বসে থাকেননি আবুল মাল আবদুল মুহিত। এসময় তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থাতেও কাজ করেছেন তিনি। ১৯৮২-১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। ওই সময় তিনি সংসদে দুইটি বাজেট উত্থাপন করেন। একই সময়ে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ থেকে এসকাপের প্রথম চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হন তিনি।
পরে বিশ্বব্যাংকসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন আবদুল মুহিত। কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), আইডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগে যোগ দেন ২০০১ সালের অগাস্টে। পরের বছর দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন তিনি। পরে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সিলেট-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
পরে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল মুহিত। সেবারেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি ফের অর্থমন্ত্রী করা হয় তাকে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ওই নির্বাচনে তার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পান তার ছোট ভাই ড. এ কে আবদুল মোমেন, যিনি বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার আগেই আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিবাগত রাত পৌনে ১টায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন নানামুখী পরিচয়ে গৌরবজ্জ্বল একটি জীবন পার করে দেওয়া মুহিত।
সারাবাংলা/টিআর