যা ইনকাম তাই খরচ, তাও বাড়ি যাই বাপ-মায়ের লগে ইদ করতে
৩ মে ২০২২ ০০:৫৭
ঢাকা: ইদ মানেই স্বজনদের সঙ্গে কাটানো খুশির সময়, ইদ মানেই আনন্দ। আর এই আনন্দকেই পূর্ণতা দিতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরে যায় মানুষ। ইদের আনন্দে দেখা হবে প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে— এমন আশা নিয়ে বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ ব্যক্তিগত গাড়িতেও অনেকে বাড়ির পথে।
ইদের আনন্দে কোনো ধনী-গরিবের ভেদাভেদ না থাকলেও ইদযাত্রায় সবার একইভাবে বাড়ি ফেরার সামর্থ্য হয় না। ট্রেনের টিকেট বেশি দামে কেনার সামর্থ্য না থাকা ও বাসের টিকেট কেনারও সামর্থ্য না থাকায় জীবনের ঝুঁকি জেনেও অনেকেই বাড়ি ফিরে বাস, ট্রাকের ছাদে চড়েই। আবার অনেকে বাড়ি ফেরার জন্য বেছে নেয় ছোট বড় পিকাপ থেকে শুরু করে পণ্যবাহী ট্রাকেও। ক্লান্ত শরীরে চোখে ঝিমুনি ভাব থাকলেও এক হাত দিয়ে ট্রাক-পিকাপের ডালা ধরে রেখে বাড়ির পথে যাত্রা হাজার হাজার মানুষের। দেশের আইন অনুযায়ী এভাবে যাত্রার নিয়ম না থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষের তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এই সুযোগে ঝুঁকি জেনেও কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায় তাদের নিয়ে ছুটে চলে ট্রাক, পিকআপ চালকেরা।
নিম্ন আয়ের এই মানুষদের মাঝেই একজন ৩২ বছর বয়সী খুলনার রহিস মিয়া। চট্টগ্রামের একটি নির্মাণাধীন ভবনে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি। সোমবার (২ মে) কাজ থেকে ছুটি নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে।
চট্টগ্রামের বড় পোল থেকে অলঙ্কার মোড় পর্যন্ত যান লোকাল বাসেই। খুলনা পর্যন্ত বাসের ভাড়া এক হাজার টাকার বেশি। কিন্তু মাসে যা ইনকাম তাতে এতো টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না।
রহিস মিয়া বলেন, ‘আট হাজার টাকা বেতনের মাঝে বাপের জন্য পাঞ্জাবি কিনছি, এক জোড়া স্যান্ডেল আর একটা টুপি কিনলাম। আম্মার জন্য স্যান্ডেল আর একটা তসবিহ কিনলাম। আম্মা চট্টগ্রাম থেকে অল্প শুঁটকি নিতে বলছেন, সেগুলো নেওয়ার পরে বৌয়ের জন্য একটা শাড়ি নিছি। আর ভাইয়ের জন্য একটা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি কিনছি। আমার বাচ্চার বয়স সাড়ে তিন মাস। তার জন্যও একটা জামা কিনছি। সব মিলিয়ে প্রায় টাকা শেষ।’
তিনি বলেন, ‘হাতে যে টাকা আছে তা দিয়ে যদি এক হাজার টাকার বাসে উঠি তবে ফেরত আসতে গেলে আবার হাওলাত করতে হবে। কিন্তু ঘরে তো আর কেউ ইনকাম করে না। তাই হিসেব করে চলা। অলঙ্কার থেকে ট্রাকে করে লালপোল পর্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে আরেকটা ট্রাকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে এই পিকাপে উঠেছি৷ এইটা দিয়ে ফেরিঘাট পর্যন্ত যাবো। এরপরে দেখা যাক কি আছে কপালে! সব মিলিয়ে তিন থেকে চারশ টাকায় আশা করছি পৌঁছে যাবো বাড়িতে।’
পিকআপে এভাবে ইদযাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন কি হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে রহিস বলেন, ‘কপালে মরা লেখা থাকলে তো যেকোনো সময়েই হইতে পারে। সারা বছরই তো কষ্ট করি। ইদের দিনটা যদি মা বাপের লগে কাটাইতে না পারি তবে কি লাভ আর টেকা কামাইয়া? তাই যাই ইনকাম সেটাই খরচ করি ইদে বাড়ি যাইতে।’
একই পিকআপ ভ্যানে যাত্রা করছেন সুরুজ মিয়া নামে একজন চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি। ফেনী থেকে তিনি রওয়ানা দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও যাওয়ার উদ্দেশে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসেবে কাজ করি ছাগলনাইয়া। সেখান থেকেই রওয়ানা দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কি আর বড়লোকের ইদের কথা ভাইবা লাভ আছে? গরিবের ইদ মানেই তো গরিবি চিন্তাতেই করতে হবে। গ্রামে গিয়ে মসজিদে ইদের নামাজটা পরবো বাবা আর ছেলের সঙ্গে। এইটাও যদি করতে না পারি তবে আর কাজ করে কি লাভ?’
পিকআপের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তার নাম সেলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি থাকলেও কিছু বাড়তি ইনকাম হলে একটু সুবিধা হয়। রাস্তায় প্রশাসনকেও টাকা দিতে হয়। আর তাই কেউ কিছু বলে না।’
রাস্তায় এভাবে পিকআপ, ট্রাক বা অন্যান্য পরিবহনের ছাদে মানুষ চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে প্রশাসন কড়া নজরদারি রাখে। কিন্তু এরপরেও দেখা যায় লুকোচুরি করে ঝুঁকি নিয়েই মানুষ এসব গাড়িতে যায়। এক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানার অনুরোধ করি নিজেদের প্রাণের স্বার্থেই।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও