।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজীবকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয় তখন তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হয়নি, আর যখন প্রয়োজন হলো তখন তার শারীরিক অবস্থা উপযোগী ছিল না-চিকিৎসকরা রাজীবের অস্ত্রোপচার করার সুযোগই পেলেন না। রাজীবের বিষয়ে এ পর্যন্ত যা হয়েছে পুরোটাই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান শাহীন।
অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান রাজীবের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ছিলেন।
মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) রাত ১২টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসকরা রাজীবকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। তবে গত এক সপ্তাহ ধরেই রাজীব ছিলেন ডিপ কোমায়। রাজীবের চেতনা স্তর ছিল তিন এর মতো, যেখন থেকে খুব ‘এক্সেপশনাল’ কিছুর জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে চলে গেলেন রাজীব।
অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান বলেন, রাজীবের কাটা হাতের ছবিটি যখন পত্রিকার পাতায় দেখলাম, তখনই সিদ্ধান্ত নেই ওকে এখানে আনতে হবে। ততক্ষণে শমরিতা হাসপাতালে ওর অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে, সেখানে অস্ত্রোপচার করেছেন আমাদের হাসপাতালেরই একজন চিকিৎসক। আমি তার সঙ্গে কথাও বলি। তিনি জানান, ছেলেটি দরিদ্র পরিবারের, বেসরকারি হাসপাতালের খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তাকে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, এনি হাউ তাকে এখানে নিয়ে আসুন। বহির্বিভাগ না নিয়ে জরুরি বিভাগে আনার পরামর্শ দেই, ৪ এপ্রিল রাজীবকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শমরিতা হাসপাতালে রাজীবের হেড ইনজুরি ধরা পরেনি, সে কিন্তু কথা বলেছিল। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তির পরদিন সকালেই রাজীবের জন্য সাত সদস্যর একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়, যেখানে দু’জন নিউরোসার্জন ছিলেন। তার সিটিস্ক্যান করা হয়, দেখলাম তার মাথায় আঘাত রয়েছে। নিউরো সার্জনরাও বললেন, সে কথা বলছে সুস্থ মানুষের মতো, তার জিসিএস (গ্লাসগো কোমা স্কেল) লেভেল ছিল ১৫, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের যেমন থাকে। একটু মানসিক বিপর্যয় স্বাভাবিক- রাজীব খাচ্ছিল না, একটু অভিমানী আচরণ করত। সেটা তার ইমোশনের জন্য হতে পারে, আবার ব্রেইন ইনজুরির কারণেও হতে পারে- আলাদা করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল।
পরে তাকে বোঝানো হলো, আমরা তাকে কনভিন্স করলাম সহযোগিতা করব। সে বুঝলো, ভালোই রেসপন্স করছিল।
ধরে আসা গলায় তিনি বলেন, কিন্তু গত মঙ্গলবার ভোর রাত ৪টার দিকে হঠাৎ করেই তার কনশাস লেভেল বা চেতনা স্তর নেমে যায়। তার আগের রাত ১২টা পর্যন্ত তাকে আমি ভালো দেখেছি। সোমবার করা তার দ্বিতীয় সিটিস্ক্যান রির্পোটও ভালো ছিল। চিকিৎসকরা বললেন, তার অবস্থা উন্নতির দিকে, আমরা আরও আশাবাদী হয়ে গেলাম।
কিন্তু মঙ্গলবার রাতে যখন অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, চেতনা স্তর কমে আসছে। চিকিৎসকরা ভাবলেন হয়তো গলায় কিছু আটকে গেছে, এমন হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, নেবুলাইজ করলো। রোগীর একটু উন্নতি হলো, শ্বাস-প্রশ্বাস ভালো নিতে পারছিল। কিন্তু দুই থেকে তিনঘণ্টা ভালো থাকার পর আবার একই অবস্থা- আর উন্নতি হলো না। তখনই তাকে লাইফ সার্পোটে নেওয়া হলো। অথচ লাইফ সার্পোটে নেওয়ার মতো রোগী ছিল না রাজীব। তাকে আইসিইউ থেকে স্থানান্তর করার চিন্তা করা হচ্ছিল।
নিউরোসার্জন, মেডিসিন, আইসিইউ এবং অর্থোপেডিকস মিলে প্রতিদিন তাকে দেখা হচ্ছিল। যখন ভেন্টিলেশনে চলে গেল তখন তার আরেকটি সিটিস্ক্যান হয়- সেই রির্পোট ছিল ভিন্ন। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সিটিস্ক্যান রির্পোটে আমূল পরিবর্তন। সেটা মূল্যায়ন করে সার্জারি করার কথাও বলা হলো, কিন্তু রাজীবের ওই অবস্থায় সার্জারি করা সম্ভব ছিল না, কোনো সুযোগই ছিল না।
চিকিৎসকরা বললেন, রাজীবের মাথার ভেতরে ‘সাইলেন্ট কনর্ভারশন’ (মস্তিষ্কের ভেতরে খিঁচুনি) যেটা শারীরিকভাবে বাইরে প্রকাশ পায়নি। মস্তিষ্কের যে অংশ অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে আঘাত পেয়ে সেটা চাপে গিয়েছিল। আটকে গিয়েছিল শ্বাস-প্রশ্বাস। তখনও সার্জারি করার কথা ভেবেছিলাম আমরা। কিন্তু আমরা অসহায় ছিলাম, অবস্থার উন্নতি হলেই কেবল অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হতো।
সেদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নিউরো সার্জন বিভাগের অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া এসেছিলেন। তিনিও দেখে বললেন, সার্জারি করার মতো অবস্থায় রাজীব নেই।
হৃদপিণ্ড, ফুসফুস এবং কিডনি সবকিছু চলছিল, আমার স্যাটিসফাইড ছিলাম মন্তব্য করে তিনি বলেন, কিডনি একদিন খারাপ হয়ে যায়, সেটাও ওষুধ দিয়ে ঠিক করা হলো। আমাদের ভাবনা ছিল, ইয়াং ছেলে-কিছুদিন সার্পোট দিলে হয়তো একটা ভালো ফলাফল আসতে পারে। যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। কিন্তু আশা ছাড়িনি। গতকালও সে ভালো ছিল, কিডনি, ব্লাড প্রেসার- সব প্যারামিটার মিলিয়ে ভালো ছিল।
কিন্তু গত রাতে শেষ সময়ে ফুসফুস কাজ করছিল না। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়েও কাজ হচ্ছিলো না। পরশু জ্বর ছিল, তবে কমে এসেছিল। কিন্তু কালকের জ্বরের লক্ষণটা খারাপ ছিল। এসব জ্বর ফুসফুসের প্রদাহ ইনডিকেট করে।
আইসিইউতে কোনো রোগীকে বেশি দিন রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ওষুধ দেওয়ার ফলে রোগী এমনিতেই দুর্বল থাকে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে অন্য রোগীদের জীবাণু আক্রমণ করে, জীবাণু আরও বেশি ‘হাইপার অ্যাক্টিং’ হয়ে যায়।
ফুসফুস যখন অক্সিজেন নিতে পারে না, তখন হৃদপিণ্ডও কাজ বন্ধ করে দেয়- কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যায়। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে রাজীবের মৃত্যু হয়, মারা গেল রাজীব।
‘খুব দঃখজনক, কী বলব…’ আফসোসের সুরে বলেন তিনি। তিনি বলেন, রাজীবের মাথার খুলির অস্ত্রোপচার যদি করা সম্ভব হতো- এক ঘণ্টার কাজ ছিল। তারতো দরকারই হয়নি।
সারাবাংলা/এটি
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook