ইদ আনন্দকে হার মানিয়ে কান্নার শব্দই যেখান থেকে বেশি ভেসে আসে
৪ মে ২০২২ ২২:৩২
ঢাকা: চাঁদরাত, অর্থাৎ ইদের আগের রাত। ঘড়ির কাটা তখন ১টা ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) জরুরি বিভাগের সামনে এসে পৌঁছে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা। দ্রুততার সঙ্গে সেই অটোরিকশা থেকে দুজন গুরুতর আহত রোগীকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নিটোরের জরুরি বিভাগে।
এর পর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় অটোরিকশাচালক সিরাজুল ইসলামের। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইকবাল রোডে (মোহাম্মদপুর) প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ কয়েকটা বাইক দেখি জোরে চালিয়ে যাচ্ছে। একটা বাইকের সামনে পাথর থাকায় আর কন্ট্রোল করতে পারে নাই। এই দুজনই তখন বাইক থেকে পড়ে গেছে। আশেপাশের লোকজন আমার গাড়িতে উঠাইয়া দিয়ে বলল, পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সঙ্গে তাদের একজন বন্ধুও আছে। আর অন্য বাইকগুলোও গেটের বাইরে আছে।’
অটোরিকশায় আসা আহতদের বন্ধুর কথা বলে জানা যায়, দুর্ঘটনার শিকার তরুণের নাম ফাহিম উদ্দিন। চাঁদরাতে বন্ধুরা মিলে বাইক চালিয়ে রাস্তায় আনন্দ করছিল। এমন সময়েই এই দুর্ঘটনা ঘটে। এখনো ওদের পরিবারকে কিছু জানানো হয়নি।
সোমবার (২ মে) সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও দেখা যায় একই চিত্র। একদিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের কান্না ও অন্যদিকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যস্ত থাকা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ব্যস্ততা।
চাঁদরাতে থেকে শুরু করে ইদের দিন মানেই স্বজনদের সঙ্গে কাটানো খুশির সময়। ইদ মানে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরোঘুরি, আর আড্ডা দিয়ে বেড়ানোর সুযোগ। ইদ মানেই আনন্দের উচ্ছ্বাস। তবে সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশের মাত্রায় কিছুটা অসতর্কতা দেখা দিলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা। চিকিৎসকরা বলছেন, চাঁদ রাত থেকে শুরু করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনার শিকার রোগীর সংখ্যাই বেশি। এর মাঝে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের সংখ্যাই সাম্প্রতিক সময়ে বেশি বাড়ছে। শুধুমাত্র প্রাণহানিই নয়, বরং অনেককে পঙ্গুত্বও বরণ করতে হচ্ছে ইদ উৎসব পালন করতে গিয়ে। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, চাঁদ রাতের প্রথম ক্ষণ থেকে শুরু করে ইদের দিন ও এর পরে দুই থেকে তিন দিন পর্যায়ক্রমে মোটরবাইক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাই বেশি।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) জরুরি বিভাগের এক স্বাস্থ্যকর্মী জানালেন, শুধুমাত্র চাঁদ রাতেই এখন পর্যন্ত ১৭ জন রোগী এলো মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে। জরুরি বিভাগের কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রাত ৯টা থেকে পঙ্গু হাসপাতাল বলে পরিচিত নিটোরের জরুরি বিভাগে ৭৭ জন টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে শুধুমাত্র মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এসেছেন ৪২ জন। এছাড়াও ১১ জন নিটোরসংলগ্ন এলাকায় চাঁদ রাত উপলক্ষে পটকা বাজি ফোটাতে গিয়ে আহত হয়ে এসেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইদের ছুটিতেও আমাদের জরুরি বিভাগে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। জরুরি বিভাগে যে অস্ত্রোপচার কক্ষ আছে সেখানেও রোগীরা এখন চিকিৎসা নিচ্ছে। অনেকের এক্সরে প্রয়োজন হচ্ছে। সেগুলো করানো হচ্ছে। আর এর মাঝে অধিকাংশই মোটরবাইক দুর্ঘটনার পরে আসা কেইস। চাঁদরাত থেকে শুরু করে ইদে যত সময় গড়াবে ততই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।’
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টা বেজে ৩০ মিনিট। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও দেখা যায় প্রায় একই দৃশ্য। জরুরি বিভাগের কাউন্টারে কথা বলে জানা যায়, রাত ৯টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ১১২ জনের মতো রোগী টিকিট কেটেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই মোটরবাইক দুর্ঘটনার শিকার। জ্বর, সর্দি, কাঁশি নিয়ে রোগীরা এলেও পরিমাণে খুবই অল্প।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি বিভাগে এখন যারা সেবা নিতে আসেন তাদের মাঝে অধিকাংশই মোটরবাইক দুর্ঘটনার পরে বিভিন্ন ইনজুরি নিয়ে আসা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যান্ডেজ করে দিলেই রোগীরা বাসায় ফিরে যেতে পারে। গুরুতর অবস্থায় আসা রোগীর সংখ্যাও একবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। চাঁদ রাত থেকে শুরু হয়ে দেখা যায় ইদের দিন, রাত ও এরপরেও এক/দুই দিন এমন অবস্থা চলতে থাকে।’
ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত ২টা তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই ইদের নামাজের প্রস্তুতি নেবে মানুষ। সরেজমিনে এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা যায়, একদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শিকার হয়ে আসা রোগী, অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রেফার হয়ে আসা রোগী। একইসঙ্গে পারিবারিক কলহ ও জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীদের সংখ্যাও এই হাসপাতালে নিতান্তই কম না।
ঢামেকের জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে যোগাযোগ করে জানা যায়, শুধুমাত্র রাত ১২ টা থেকে সোয়া দুইটা পর্যন্ত ২৬৯ জন চিকিৎসা নেওয়ার জন্য টিকিট কেটেছেন। জরুরি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছিলেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. কিশোর সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাঁদরাতে মোটরবাইক দুর্ঘটনার অনেক রোগীই আসে। তবে সময় যত বাড়তে থাকে তত রোগীর সংখ্যাও বাড়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ থেকে কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সবাইকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। রোগীরাও জানে এখানে এলে চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত যেতে হবে না। আর তাই সবাই এখানেই আসে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানের হাসপাতাল থেকেও রোগীদের এখানে রেফার করা হয়ে থাকে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবা চলছে। আর আন্তঃবিভাগে থাকা রোগীদের চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। যে কোনো পরিস্থিতিতে এখানে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানের সকল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কিন্তু মোটিভেটেড। আমরাও তাদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাই।’
তিনি বলেন, ‘আজ ৬০০ জনের বেশি কিন্তু জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে পুলিশ কেইস- যেমন মারামারি ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসার রোগীর সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি। এর মাঝে ১৫০ জনের বেশি রোগীকে ভর্তিও করা হয়েছে। দেশে যদি হঠাৎ কোনো জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন- তার জন্যেও আমাদের র্যাপিড রেসপন্স টিম প্রস্তুত থাকে। যদি প্রয়োজন হয় তবে ৩০ মিনিটের মধ্যেই তারা এসে কাজ করতে পারবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোগীদের সেবা দেওয়া চিকিৎসকের দায়িত্ব। কিন্তু কোনো চিকিৎসকই চাইবে না রোগীর সংখ্যা দেশে বাড়ুক। আর চাঁদ রাত বা ইদের সময় কেউ অসুস্থ হোক এমনটাও কেউ চাইবে না। কিন্তু তারপরেও রোগীরা জরুরি বিভাগে আসে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানের জরুরি বিভাগে সেই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়।’
তিনি বলেন, ‘চাঁদরাত বা ইদের দিনে জরুরি বিভাগে রোগীর অনেক চাপ থাকে। কারণ এদিন মানুষ অনেকটা লাগামহীনভাবেই ঘোরে বাইরে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণরা বাইকে করে ঘোরে আর বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে। চিকিৎসকদের পেশার সঙ্গে কিন্তু মানবিক ও মানবতা দুটো দিকই জড়িত। তাই হাসপাতালে যখন রোগী আসে তখন পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়ার চাইতে বেশি জরুরি হয়ে পড়ে মানবতার সেবা করা।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম