Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সড়ক দুর্ঘটনা: যে সমস্যার সমাধান দেশে কখনোই খোঁজা হয়নি


১৭ এপ্রিল ২০১৮ ২১:১৮

||মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর||

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনের সংবাদের একটি নিয়মিত বিভাগে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই খবরের একটা অংশ জুড়ে থাকে সড়ক দুর্ঘটনা ও এর কারণে হওয়া আহত ও নিহতের সংখ্যা।

যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা প্রতিদিন শোনা যায় তার একভাগও সংবাদ আসে না সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, দুর্ঘটনার পরে আইন প্রয়োগ বা বিচারের ঘটনা। সর্বশেষ চার এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় হাত হারানো তরুণ রাজীবের মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) মৃত্যুর পরে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়টি আবার ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্য আড্ডা-আলোচনায় সকলের মুখে মুখে একটাই কথা, এই মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায়?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (এআরআই)-এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, এ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশ বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারিয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতির এ পরিমাণ বাড়ছে প্রতি বছর, কারণ সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ও আহতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিবছর। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল কমিটি টু প্রোটেক্ট শিপিং, রোডস অ্যান্ড রেলওয়ে (এনপিএসআরআর) ২২টি জাতীয় পত্রিকা, ১০টি স্থানীয় পত্রিকা ও ৮টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে পাওয়া খবর বিশ্লেষণ করে একটি মাধ্যমিক গবেষণা চালায়। সে গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫.৮২% এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েছে ২৫.৫৬%। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৪৭২টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ২৮৪ জন আর আহত হয়েছেন ৯ হাজার ১১২ জন।

নিহত ও আহতের এই সংখ্যা আরও বেশি দেখা গেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির করা প্রাথমিক গবেষণার ফলাফলে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, আমাদের প্রাথমিক গবেষণা থেকে আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ৩৯৭ জন আর আহত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মার্চ মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪২৯টি, এতে নিহত হয়েছেন, ১ হাজার ৪৪১ জন এবং আহত হয়েছেন, ৪ হাজার ৩৮০ জন।

আজ (১৭ এপ্রিল) সকালেও গোপালগঞ্জে হৃদয় নামে ২০ বছরের একজন তরুণ বাস ট্রাকের সংঘর্ষে রাজীবের মতো একইভাবে তার একটি হাত হারিয়েছেন।

জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কে নিরাপদ সড়ক গঠনের লক্ষ্য বেঁধে, নিরাপদ সড়ক গঠন দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১০ সালে যখন এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তার উদ্দেশ্য ছিল সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা।
নিরাপদ সড়ক গঠন দশক অর্জনের চারটি স্তম্ভ ছিল, এগুলো হলো-

  • অবকাঠামো উন্নয়ন
  • সব ধরণের যানবাহনের জন্য পথ নির্ধারণ করা এবং সেগুলো নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ন করা।
  • নিরাপত্তা নিশ্চিত করত প্রযুক্তির ব্যবহার
  • নিরাপদ সড়কের জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ

এই চারটি স্তম্ভের একটিও নিয়ম করে মানা হয় না বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এখনও মেয়াদ উত্তীর্ণ বাহন ব্যবহৃত হয়, আধুনিক প্রযুক্তির প্রণয়ন তো হয়ই না বরং স্থানীয়ভাবে নির্মিত বাহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। নিয়ম ভেঙ্গে এক লেন থেকে আরেক লেনে ঢুকা যাওয়া এখানে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একই লেনে মোটর যান এবং মানুষ চালিত যান চলাচল করছে অনায়াসেই।

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের জন্য কোনো আইন নেই, খসড়া আইন ঝুলছে অনেকদিন ধরেই। খুব বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে বা গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তি মারা না গেলে সে ঘটনা বিচারের আওতায় আনার নিদর্শন খুব বেশি নেই। উপরন্তু, কোনো দুর্ঘটনার বিচার হলে তার বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিক নেতারা আন্দোলন করে যার সহায় হন সরকারের মন্ত্রীরাও।

২০১১ সালের ১৩ই অগাস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় বিপরীতগামী যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসে থাকা চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হন।

২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলার রায় হয় যাতে ঘাতক বাসের চালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে পরিবহণ শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকেন, এতে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সারাদেশ থেকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাংলাদেশ সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। সে সময় তিনি সরকারের মন্ত্রীর চেয়ে বেশি ফেডারেশনের নেতার ভূমিকা পালন করেন, এবং রায় মেনে না নিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে বক্তব্য দেন।

অভিযোগ আছে, মন্ত্রীর বাসভবন থেকে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ধর্মঘটের ফলে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পরে। সে সময় মন্ত্রীর শ্রমিকদের পক্ষে দেওয়া, “চালকরা মনে করছেন মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না” বক্তব্যটি বিপুল সমালোচিত হয়।

এর বাইরেও এনসিপিএসআরআর সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অনেকগুলো বিষয় চিহ্নিত করে যার কোনোটিই এখন পর্যন্ত সমাধান করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নিরাপদ সড়ক চাই ২০১৭ সালে তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয় তার শতকরা ৫০ ভাগের বেশি মানুষ পথচারী। নিরাপদ সড়ক চাই-য়ের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জানান,

“সড়ক দুর্ঘটনার কারণ শুধু সড়ক নয়, বরং সড়কের পাশে থাকা ফুটপাথ দখল, সঠিক রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা না থাকা এবং আইন না মানা।”

নিরাপদ সড়ক চাই, এনসিপিএসআরআর ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রত্যেকেরই দাবি একটি আইন তৈরি হলে, সেটি যথাযথভাবে মানা হলে এবং সকল পক্ষ যদি সচেতন হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসা সম্ভব। কিন্তু বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (এআরআই) জানাচ্ছে, সমাধান এতই সহজ নয়।

এআরআই’র প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার সারাবাংলাকে জানান, সড়ক দুর্ঘটনা সমস্যার সমাধান বাংলাদেশে কখনও খোঁজাই হয়নি।

ড. মাহবুব বলেন, “যে কোনো বিষয়ে সফলতা আসতে হলে সে বিষয়ে গবেষণা করতে হবে, নাহলে সঠিক সমাধানই জানা যাবে না।” 

এ গবেষকের মতে, বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় ছোট ছোট গবেষণা চালাতে হবে যেন সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে। এসব কারণ বিবেচনা করে চালক, পথচারী, যাত্রী, যানবাহন চলাচলের নিয়ম তৈরি করা হলে এবং তা মেনে চলা নিশ্চিত করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

সারাবাংলা/এমএ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর