ভাঙনের ঝুঁকিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট
৫ মে ২০২২ ১০:৫৫
ঢাকা: ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। যেকোনো সময় জোটের একটি শরিক দল নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্মে যোগ দিতে পারে। এমনকি জোটে দ্বিধাবিভক্তি শুরু হতে পারে বলেও আশঙ্কা শরিক দলগুলোর।
সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনসহ জনজীবনের সংকট নিরসনে সমমনা দলগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রেখে আসছে জোটটি। বাম জোটের নেতারা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এজন্য সমমনাদের নিয়ে বড় একটি রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলবে। কিন্তু জোটের শরিক দলগুলোর নানা মতানৈক্যের কারণে জোটের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। ফলে বাম জোটের পরিধিও আর বাড়ছে না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যুগপথ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও জোটের শরিক দলগুলোর রয়েছে দ্বিমত। ফলে আগামী ৯ মে বাম জোটের সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় অভ্যন্তরীণ সকল বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণসহ সিদ্ধান্ত হবে— বড় কোনো দলের সঙ্গে এক ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করবে, নাকি একলা চলো পথ অবলম্বন করবে। অপরদিকে বাম জোট বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সরকার পতনের যুগপথ আন্দোলনে মাঠে নামবে, নাকি বাম জোট একলা চল পথ বেছে নিবে সে বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসবে।
তবে জোটের শরিকদের একাধিক নেতা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যুগপথ আন্দোলন ও জোটের প্রতি সংহতি বাড়ানোর প্রস্তাব করবেন। তাদের মতে জোটের শরিক দলের প্রস্তাবে জোটের অন্যতম শরিক দল সিপিবিসহ অন্য শরিক দলগুলো সমর্থন না দিলে, বাম জোট ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, শরিক দলের অনেক নেতাকেই বলা হবে, বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ার লড়াইয়ে যদি থাকতে চান তাহলে থাকুন। আর না হয়, অন্য পথ বেছে নিতে পারেন।
ওই নেতা জানান, বাম গণতান্ত্রিক জোটের গঠনে যাদের ভূমিকা ছিল তারা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের ভূমিকায় বিব্রতবোধ করছেন। জোটের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।
এ বিষয়ে সাইফুল হক বলেন, বর্তমান কর্তৃত্ববাদি ফ্যাসিবাদি সরকারের পতন ঘটাতে যুগপৎ আন্দোলনের কোনো বিকল্প নাই। জনগণের ভাত ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সমন্বিত আন্দোলন করতে হবে। এই কথা আমরা জোটেও বলেছি। জোটের মিটিংগুলোতে আমাদের এই কথাগুলো নিয়েই আমরা অবস্থানে থাকব। একটা নাগরিক মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য আমাদের চেষ্টা চলছে এই কথা সত্য। তবে আমাদের নিয়ে বন্ধুরা বিব্রত বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেখানে আমরা অবস্থান নেবো না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিপিবি ছাড়াও বাম জোটের কয়েকটি শরিক দল আলাদা রাজনৈতিক প্লাটফর্মে যোগ দিতে পারে। ইতোমধ্যেই বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার, নাগরকি ঐক্য, জাসদ রব ও মোস্তফা মোহসিন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ঐক্যবদ্ধভাবে একটি রাজনৈতিক জোট করার জন্য ২-৩ মাস আগে থেকে চেষ্টা করে আসছে। এই ৭টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক মঞ্চে উঠেই জাতীয় ঐক্যগড়ে তোলার আহ্বান জানাবে। বিএনপি এতে সাড়া দেবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে এক্ষেত্রে সিপিবি তার আগের অবস্থানেই রয়েছে।
সিপিবির একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে রাজপথে থেকেই বড় ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। কোনো ড্রইং রুমে বসে ঐক্য হবে না। অন্যদিকে কয়েক মাস ধরে গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টি, রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য জাসদ রব, নাগরিক ঐক্য, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, গণফোরাম মন্টুর সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গেও তাদের আলোচনা হচ্ছে। তবে বিএনপিকে তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে বাদ দিলে তারা বিএনপির সঙ্গেও ঐক্য করতে রাজি আছে। সূত্রটি বলছে, ওই ৭ দলের নেতারা ঐক্যমতে পৌঁছালেই সংবাদ সম্মেলন করে তাদের রাজনৈতিক প্লাটফর্মের নাম ঘোষণা করবে। এই দাবির প্রতি যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যারা আছে, তাদের সবার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে পারে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটও এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
অপরদিকে বাম জোটের নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ৯ মে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সভায় জোটের অভ্যান্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণসহ যুগপথ আন্দোলনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে তারা। সরকারের প্রশ্রয়ে বিনাবিচারে গুম খুন, মানি লন্ডারিং চলছে। এসব থামাতে বাম প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ঐক্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কর্মসূচি দেওয়ার সিন্ধান্ত নেওয়া হবে ওই বৈঠকে।
বাম জোটের বিশ্বস্ত একটি সূত্র বলেছে, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন বাম জোট থেকে সরে যেতে পারে। এতে করে বাম জোট অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়। বাম জোটের শুরুতে আটটি দল ছিল। দলগুলো হলো- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লিগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটা অংশ বেরিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্ক্সবাদী) নামে নতুন দল করে। এই দলটিও বাম জোটে যুক্ত হয়। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেবল তিনটি বড় দল সিপিবি, বাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। এই জোট থেকে বা শরিক কোনো দল থেকে কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি এখন পর্যন্ত। তবে স্বৈরসরকার এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে সিপিবির পাঁচজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এসব বিষয় নিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সারাবাংলাকে বলেন, প্রথমত বাম গণতান্ত্রিকজোট কোনো ঝুঁকিতে নেই। কারণ জোট ঝুঁকিতে থাকে, যখন তার পলিটিক্স নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকে তখন। কিন্তু আমরা বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের অবসান চাই, ব্যবস্থা বদল করতে চাই এবং দ্বিদলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে চাই। এরজন্য জনগণের এক্য গড়ে তুলতে চাই। এই হলো আমাদের পরিস্কার বক্তব্য।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ যদি কখনো এসব আপলড না করেন, তখন তার ডিসিশন তাকে নিতে হবে। তারপরও যদি কেউ চলে যায়, সেটি তার বিষয়। বাম গণতান্ত্রিক জোট ইতোমধ্যেই জনগণের মাঝে যা দিয়েছে তা জনগণ গ্রহণ করেছে।
এছাড়াও বাম জোটের কয়েকজন নেতা বলছেন, করোনাকালে দুর্নীতি, ধর্ষণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাজুক দশা নিয়ে করোনার মধ্যেও কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁরা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালন করে জনগণের সমর্থন পেয়েছেন। ব্যাপক মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করাই এখন তাদের লক্ষ্য। ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। এজন্য তাদের আনেদালন সংগ্রম অব্যাহত থাকবে। আর আন্দোলন সংগ্রাম জোরদার করতে জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এএম