।। জবি করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: শিক্ষার আলোর উন্মুক্ত বিচ্ছুরণ ঘটাতে যে পাঠাগার গড়ে উঠেছিল সেখানে আজ গুমট অন্ধকার। বছরের পর বছর একটি সুরম্য ভবন ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঠকের দিকে তাকিয়ে। অথচ তার বন্ধ কপাটই বলে দেয় সেখানে ঢুঁ-মারার সময় নেই কোনো জ্ঞান তাপসের। সময় এবং সদিচ্ছার এতোই অভাব যে নাগরিকেরা ও মুখো হন না। ফলে হাজারো জ্ঞানের বইগুলোয় জমা ধুলোও আর সরে না। এভাবে দেশের প্রথম গণগ্রন্থাগার ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’ পাঠক বিনে এখন নিজেই হাহাকারের গল্প হয়ে নীরবে বসে আছে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা পাটুয়াটুলীতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রাহ্ম সমাজের গেট দিয়ে ঢুকতেই একটি জরাজীর্ণ ভবনের সামনে লেখা আছে ‘রাজা রাম মোহন রায় পাঠাগার’। পাঠাগারটির ভাঙ্গা চৌকাঠে তালা লাগানো। ভিতরে ঢুকে দেখা গেল যে কয়েকটি আসবাবপত্র আছে তার ওপর ধুলাবালির স্তুপ। এখানে যে কারো পায়ের ছাপ পড়েনি সে বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়।
ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৭১ সালে ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা,ধর্মালোচনা, ও সমাজ সংস্কার মূলক কাজের পাশাপাশি একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম সূচনাকারী অভয় চন্দ্র দাস। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন এর নামানুসারে পাঠাগারটি ‘রামমোহন গণ-পাঠাগার’ নাম করণ করা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দানে দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্র গ্রন্থের অসাধারণ সংগ্রহশালা হয়ে ওঠে এটি। তবে একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনীর রোষাণলে পড়ে ধংস হয়ে যায় বাঙালির অমূল্য সম্পদ এ পাঠাগারটি। সে সময় হানাদার বাহিনী এ পাঠাগারটি থেকে মূল্যবান বই গায়েব করে ফেলে।
পাঠাগারটি সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিতুল সারাবাংলাকে বলেন, বই পড়ে জানতে পেরেছি রামমোহন লাইব্রেরী বাংলাদেশের প্রথম পাঠাগার। তবে সেখানে কোনোদিন যাওয়া হয়নি। কোথায় তাও চিনিনা।
পাঠাগারটি সম্পর্কে মিতুলের সামান্য ধারণা থাকলেও জবির আইন বিভাগের ছাত্র নাহিদ নেওয়াজ জানেন না কিছুই। তিনি বলেন,আপনার কাছ থেকে বিষয়টি জানলাম। একদিন যাব দেখতে।
পাঠাগারটির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও লাইব্রেরী বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের রাসেল সরদার সারাবাংলাকে জানান, এটা পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে অবস্থিত। তবে সেখানে কোনোদিন যাওয়া হয়নি।
জানা গেছে, ঐতিহাসিক এ পাঠাগারটিতে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্রপাধ্যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেক গুনীজন। ১৮৯৮ সালে ঢাকা এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তিনটি দর্শনীয় স্থানের কথা বলেছিলেন, এর মধ্যে এই পাঠাগারটিও একটি।
ব্রাহ্মসমাজের পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বক্স সারাবাংলাকে বলেন, ‘একসময় ছিল যখন ঢাকা শহরে তেমন বই পাওয়া যেত না। তখন আমরা দল বেঁধে যেতাম ব্রাহ্ম সমাজের পাঠাগারে পড়তে। বিকেল বেলাটা ওই পাঠাগারেই কাটিয়ে আসতাম।
পাঠাগার ও ব্রাহ্ম সমাজের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে তিনপুরুষ থেকে ব্রাহ্ম সমাজের সাথে জড়িত বর্তমান ব্রাহ্ম সমাজর সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যাতে আগামীতে এই পাঠাগারটিকে আরো সমৃদ্ধ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারি। আমরা এর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।
পাঠাগারে পাঠক আসার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো এই পাঠাগারে পাঠক পড়তে আসে না। তবে মাঝে মাঝে কিছু শিক্ষার্থী অ্যাকাডেমিক থিসিস করতে আসেন। কখনও কখনও কিছু গবেষকও আসেন গবেষণা কর্মের জন্য। তারা আসলে তাৎক্ষনিকভাবে পাঠাগারটি খুলে দেয়া হয়। এছাড়া সবসময় বন্ধ থাকে। তবে পাঠাগারটির ভেতরে ঝাড়া-মোছার কাজ নিয়মিত করা হয় বলে রণবীর পাল রবি দাবি করেন।
সারাবাংলা/জেআর/এমএস