Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিরোধী দলের অবস্থান ধরে রাখা নিয়েই শঙ্কা জাপায়!

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ মে ২০২২ ২৩:০৫

ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের কৌশল নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে দলটি। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছে, মহাজোটে না গিয়ে  এককভাবে ৩০০ প্রার্থী দিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে তারা। কিন্তু পার্টির নেতাকর্মীরাই আগামী নির্বাচনে দলের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান।

নেতাকর্মীরা বলছেন, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পার্টির অন্যতম শক্তিশালী ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত রংপুরে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। দলের দ্বিতীয় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সিলেটেও পার্টির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে পার্টির একাধিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতবিরোধের জের ধরে। পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বেও একজোট নয় দলটি। অতীতে দুয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারলেও আগামী নির্বাচনে দলটি বিরোধী দলের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

পার্টির সূত্রগুলো বলছে, জাপার সংকট এখন বহুমুখী। বরাবরই রংপুরকে বলা হয় জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রয়াণের পর সেখানে এখন জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রমে করুণ দশা চলছে। এদিকে, রংপুরের পর সিলেটকে বলা হতো জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় ঘাঁটি। এরশাদ নিজেও সিলেটকে তার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনপ্রাপ্তির দিক থেকের দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে এগিয়ে থাকার নজিরও রয়েছে দলটির। সে পরিস্থিতি এখন সুদূর অতীত। বাকি বিভাগীয় ও জেলাগুলোর কথা বলাই বাহুল্য।

বিজ্ঞাপন

জাপা সূত্র জানিয়েছে, পার্টির ৭৭টি সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে ৩৯টিই চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। ৩৬টি জেলায় সক্রিয়ভাবে দলটির কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচি নেই। দেশের অধিকাংশ জেলায় জাপার কমিটিতে নেতায় নেতায় রয়েছে দ্বন্দ্ব, পদ-পদবী নিয়ে কর্মী-কর্মী দ্বন্দ্ব, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের আধিপাত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি নিয়েও রয়েছে বিরোধ। কোথাও কোথায় নেতাকর্মী সংকটের কারণে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমের উপস্থিতিই নেই।

জাপার কেন্দ্রীয় দফতর সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির ঢাকা বিভাগের ১৭টি কমিটির মধ্যে ১০টি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে, বাকি ৭টিতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। রাজশাহী বিভাগের ৯টি কমিটির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে তিনটিতে, বাকি ছয়টিতেই দায়িত্বে আহ্বায়ক কমিটি। রংপুর বিভাগেও ৯টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিপরীতে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে চার কমিটি। সে তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগের অবস্থা কিছুটা ভালো। এই বিভাগে পাঁচটি কমিটির মধ্যে চারটি পূর্ণাঙ্গ, একটি আহ্বায়ক। তবে করুণ দশা চট্টগ্রাম বিভাগে। চারটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিপরীতে ১০টি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে পার্টির এই বিভাগে পার্টির কার্যক্রম।

জাপা নেতাকর্মীরা বলেছেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের গত দুই বছর হলো সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। তবে সেসব উদ্যোগ সফল হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অতীতের সৃষ্ট মতবিরোধ চরমে। দলটির হেভিওয়েট নেতারা সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশ নেন না। তারা জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে মনে-প্রাণে মেনে নিতেই পারছেন না!

জাপা’র হেভিওয়েট কয়েকজন নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে সারাবাংলাকে বলেছেন, ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে জাতীয় পার্টি। দূরদর্শী পরিকল্পনা ও চিন্তা-ভাবনার কারণে স্বৈরাচার তকমা নিয়েও জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের নেতা হতে পেরেছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান  প্রায়ত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি কারাবরণ করেছেন, তবু পার্টিকে সুসংগঠিত করতে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়িয়েছেন।

ক্ষোভ নিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী এসব নেতা বলেন, এর বিপরীতে বর্তমান জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কার্যক্রম তার বাসা ও বনানী কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ। বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে তিনি দল শক্তিশালী করতে চান! ফলে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর নেতাকর্মী ও এমপিরা ভরসা করতে পারছেন না। আগামী নির্বাচনে তাই দলটির পক্ষে বিরোধী দলের অবস্থান ধরে রাখাই কঠিন হবে— এমনটিই অভিমত পার্টির হেভিওয়েট নেতাদের।

নেতাকর্মীরা আরও বলছেন, জাপা চেয়ারম্যানের মতোই পার্টির কার্যক্রমও এখন চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ও কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দলে কয়েক ডজন সিনিয়র নেতা ও ঢাউস আকারের কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও সবাই নিষ্ক্রিয়। সংসদ সদস্যদের কিছুটা সক্রিয়তা রয়েছে, তবে সেটি একেবারেই নির্বাচনি এলাকাকেন্দ্রিক। পার্টির সংগঠন সম্প্রসারণের দিকে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকায় খোদ রাজধানীতেই নেতাকর্মীরা দিনের পর দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য কমিটি কিংবা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারেই নেই।

কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে এবং সরকার গঠনেও জাতীয় পার্টি একটা সময় ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ভূমিকা পালন করত। ধীরে ধীরে পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে এখন জাতীয় নির্বাচনে ন্যূনতম ভূমিকা রাখার পরিস্থিতিই নেই। দ্বিধাবিভক্তি আর মতবিরোধে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের মর্যাদাও হয়তো হারিয়ে ফেলবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষাণার পরই পার্টি দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুখামুখি অবস্থান নেবে— এমন আশঙ্কার কথাও বলেন তিনি।

এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে অবশ্য পার্টির ভঙ্গুর অবস্থার কথা অস্বীকার করেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এসব তথ্য যারা দিয়েছেন, তারা মূর্খতার পরিচয় দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি আগের অবস্থানে নেই। অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তবে  ঢাকা মহানগরসহ বিভাগীয় শহর এবং জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কিছু সমস্যা আছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে।

জাপা মহাসচিব আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বছর দেড়েক সময় আছে। আশা করি এর মধ্যে জাপা আরও শক্তিশালী হবে। জাপায় প্রার্থীর সংকটও নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে যোগ্য ব্যক্তিরা জাপায় যোগ দিচ্ছন এবং আগামী দিনে আরও নেতারা যোগ দেবেন। আগামী নির্বাচনে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি।

নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করবে উল্লেখ করে চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টি কারও ‘ট্রাম্প কার্ড’ হবে না। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিই হবে ‘অরিজিনাল কার্ড’।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

জাতীয় পার্টি জাপা চেয়ারম্যান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাংগঠনিক কার্যক্রম সাংগঠনিক স্থবিরতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর